ইউক্রেন ইস্যুতে ভারত কোন পক্ষে, কেন?

রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রাখতে গিয়ে গত কয়েকদিন ধরে কূটনৈতিক টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভারত।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে গত ৭ দিন ধরে সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে রাশিয়া। গতকাল মঙ্গলবার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভে রুশ বাহিনীর হামলায় এক ভারতীয় শিক্ষার্থী নিহত হন। অথচ রাশিয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে কিংবা ইউক্রেনের পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি ভারত।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র ও বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতকে রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় দিল্লির দেওয়া বিবৃতিতে সরাসরি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিরসনে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে এবং আলোচনা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান শোনা হচ্ছে না বলে ভারত দুঃখ প্রকাশ করেছে।
কিন্তু, রাশিয়ার সমালোচনা করেনি ভারত। নিরাপত্তা পরিষদে আগ্রাসনের নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার আগে 'সঠিক সিদ্ধান্ত' নিতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের ফোন পেয়েছিল দিল্লি। অবস্থান স্পষ্ট করতে দিল্লির প্রতি আহ্বান জানায় ইউক্রেন ও রাশিয়া।
ভারত শেষ পর্যন্ত নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। তবে তাদের বিবৃতি দেখলে বোঝা যায়, তারা অবস্থান কিছুটা স্পষ্ট করেছে এবং পরোক্ষভাবে মস্কোকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান জানাতে বলেছে।
ভারত জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা রাখার গুরুত্ব উল্লেখ করে গঠনমূলক সমাধান খুঁজতে এগুলোর ওপর আস্থা আনতে বলেছে।
কিন্তু, নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানে ভারতের বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সামরিক আগ্রাসনের বিপক্ষে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের আরও স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করছে পশ্চিমের দেশগুলো।
এ ইস্যুতে ভারতের এমন 'জটিল' বা 'অস্পষ্ট' অবস্থানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক জে এন মিশ্র গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারতের সামনে যে সব বিকল্প আছে, সেগুলো হয় 'খারাপ' নয়তো 'বেশি খারাপ'।
তিনি আরও বলেন, 'কেউ একই সময়ে ২ দিকে অবস্থান নিতে পারে না। ভারত কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেনি। অর্থাৎ তারা মস্কোর বিরুদ্ধে যাবে না। ভারতকে পক্ষ নিতে কৌশলী হতে হয়েছে।'
ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দেওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ নেওয়া। এ দিকে, প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকে থেকে রাশিয়া ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু।
রাশিয়া ভারতের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। আগে ভারতের মোট অস্ত্রের ৭০ শতাংশ রাশিয়া থেকে আসতো, যদিও বর্তমানে তা ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনেও ভারতকে রাশিয়া সহযোগিতা করছে।
রাশিয়া ভারতকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করছে। চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে এগুলো কাজে লাগায় ভারত।
বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে মস্কোর সঙ্গে দিল্লির কূটনৈতিক সহযোগিতার কয়েক দশকের ইতিহাস উপেক্ষা করা কঠিন। যেমন, ভারতকে সমর্থন দিতে বিতর্কিত কাশ্মীর ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনে ভেটো দিয়েছে রাশিয়া।
এ সব কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের অবস্থানের বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, 'ভারতের অবস্থান দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তাদের অতীতের কৌশল এমনই ছিল।'
তার মতে, 'ইউক্রেনে যা ঘটছে, দিল্লি হয়তো তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। তবে তার অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।'
'প্রতিরক্ষা ও ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনের কারণে ভারতের এ মুহূর্তে তা করতে পারবে না,' যোগ করেন তিনি।
রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেনে অন্তত ২০ হাজার ভারতীয় আটকা পড়েছেন। তাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। সেখান থেকে তাদের সরিয়ে নেওয়ার মতো কঠিন কাজ বাকি আছে ভারতের।
মস্কো ও লিবিয়াতে কাজ করা ভারতের সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনিয়াত বলেন, আটকে পড়াদের সফলভাবে উদ্ধার করতে হলে, সব পক্ষের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন।
তিনি আর বলেন, 'নাগরিকদের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে ভারত কোনো একজনের পক্ষ নিতে পারে না। বরং ভারত সামগ্রিকভাবে সব দিকে খেয়াল রাখছে, যেন সবার সঙ্গে আলাপের দরজা খোলা থাকে।'
ওয়াশিংটন ও মস্কো উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে ভারত একটি। সেই অর্থে, ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বেশিরভাগ দেশ থেকে আলাদা।
রাশিয়া সামরিক অভিযান চালানোর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ওয়াশিংটনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও কথা বলেছেন মোদি।
ত্রিগুনিয়াত বলেন, 'দুই পক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার দরজা খোলা রাখার ক্ষেত্রে ভারত ভালো করছে।'
'ভারত সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করেনি। ইউক্রেনীয়দের দুর্ভোগের বিষয়ে ভারতের কোনো বক্তব্য নেই, এমনও নয়। তারা একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া বিবৃতিতে আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিষয়ে ভারতের জোরালো অবস্থান স্পষ্টভাবে ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
কিন্তু, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে, তবে মস্কোর সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া দিল্লির পক্ষে কঠিন হতে পারে।
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ভারতের অবস্থান বুঝতে পারছে। কিন্তু এরকমই যে চলতে থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সুনির্দিষ্ট উত্তর দেননি। তিনি বলেন, 'আমরা (ইউক্রেনের বিষয়ে) ভারতের সঙ্গে পরামর্শ করব। এর পুরোপুরি সমাধান হয়নি।'
ভারতের এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ওপরও নিষেধাজ্ঞা ঝুলছে। রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাভারসারিজ থ্রু স্যাঙ্কশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। পরের বছর রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে গেলে, ভারতকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
এ দিকে, দিল্লি কৌশল পরিবর্তন করলে মস্কো চাপ তৈরি করতে পারে। যেমন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ফেলতে পারে রাশিয়া।
রাশিয়ার সামনেই গত ২ দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু, ইউক্রেন ইস্যুই হয়তো সেই সীমারেখা, দিল্লি যা অতিক্রম করতে চায় না।
কুগেলম্যান বলেন, 'ইউক্রেন সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে এবং বিশ্বে দ্বিমেরুকরণ হলে, এমন চূড়ান্ত অবস্থান নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে।'
'আশা করি এমন হবে না। যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হবে,' বলেন তিনি।
এ অবস্থায় ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুর সমাধান শেষ পর্যন্ত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দর কষাকষি পর্যন্ত যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন।
Comments