ইউক্রেন থেকে ৪৮ ঘণ্টায় পোল্যান্ডে পৌঁছেছেন সেই ৯ বাংলাদেশি

ছবিতে ৯ বাংলাদেশির ৩ জন, ট্রেনে ইউক্রেনের সীমান্ত শহর লাভিভে যাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের সুমি শহর থেকে গত মঙ্গলবার উদ্ধার হওয়া ৯ বাংলাদেশি সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ড পৌঁছেছেন। আজ বৃহস্পতিবার পোল্যান্ড সীমান্ত থেকে তারা দেশটির রাজধানী ওয়ারশ যাবেন।

গত মঙ্গলবার তাদের উদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে পেরিয়ে গেছে ৪৮ ঘণ্টা। এই দীর্ঘ যাত্রায় তারা ক্লান্ত। তবে সবাই সুস্থ আছেন।

আজ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টায় দ্য ডেইলি স্টারকে এসব তথ্য জানান পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা।

তিনি বলেন, 'সুমি থেকে উদ্ধার হওয়া ৯ জন এখন পোল্যান্ডের ভেতরে একটা জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। তারা সবাই ভালো আছেন। তাদের সঙ্গে একটু আগেই আমার কথা হলো। তারা এসে আমাদের এখানে (ওয়ারশতে) শেল্টার হাউজে উঠবেন।'

তিনি আরও বলেন, 'এখানে এসে পৌঁছানোর পর সিদ্ধান্ত হবে তারা কী করবেন। তারা যদি বাংলাদেশে ফিরতে চান, তাহলে আমরা সেই ব্যবস্থা করব।'

উদ্ধার হওয়া ৯ বাংলাদেশির একজন রুবায়াত হাবিব আজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলহামদুলিল্লাহ, সব কিছু ঠিকঠাক মতো পার করে পোল্যান্ডে ঢুকেছি।'

যাত্রা পথের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, 'ট্রেনে আমরা লিভিভ পৌঁছাই বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে। আমাদের ট্রেনটি যে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল তার অপরপাশেই আরেকটি ট্রেন দাঁড়ানো ছিল, যেটা আমাদের ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে নিয়ে এসেছে। সেই ট্রেনে আমাদের কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।'

'ট্রেনটা ছেড়ে যাওয়ার পর কিছুটা পথ গিয়েই আবার থেমে যায়। ট্রেনটি একটু পুরনো ছিল, এর বেঞ্চগুলো ছিল কাঠের। পুরো ট্রেনে টয়লেট ছিল মাত্র ২টি। আমাদের কাছে ম্যাসেজ এলো, এখানে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ট্রেনটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এমনিতেই এই দীর্ঘ যাত্রায় সবাই ক্লান্ত। এমন সময় এমন ম্যাসেজে সবাই ত্যক্ত হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত ওখানে ট্রেনটি প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল।'

'ট্রেনটি ছাড়লে আমরা স্বস্তি পাই। কিন্তু, ২০ মিনিট চলার পরেই আবার থেমে যায় ট্রেন। সেখানে আরও ২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত আমরা রাত সাড়ে ১২টার দিকে সীমান্তে পৌঁছাই,' যোগ করেন তিনি।

২ বারে প্রায় ৭ ঘণ্টা ট্রেনটি দাঁড়িয়ে থাকার কারণ হিসেবে রুবায়াত বলেন, 'আমাদের আগে কয়েকটি ট্রেন ছেড়ে গিয়েছিল সীমান্তের দিকে। ওই ট্রেনের যাত্রীদের সব প্রক্রিয়া অনুযায়ী নামাতে সময় লাগছিল। এ জন্য আমাদের ট্রেনটিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে।'

যাত্রাপথে পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা নিয়মিত তাদের খোঁজ নিচ্ছিলেন বলে জানান তিনি।

স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলার সময় রুবায়াত জানান, তারা পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি শেল্টার হাউজে আছেন। তিনি বলেন, 'এটা একটা বিশাল শপিংমল। এই শপিংমলকে শেল্টার সেন্টার বানিয়ে ফেলেছে পোলিশ সরকার।'

সেখান থেকে ওয়ারশতে কখন যাবেন জানতে চাইলে রুবায়াত বলেন, 'এখান থেকে বাস, গাড়ি ওয়ারশ যাচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে কিছু ভাড়া নিচ্ছে, আবার কিছু আছে ফ্রি। রাত ৩টার দিকে একটি ট্রেন ছিল। ট্রেনের সব সিট বুক হয়ে গেলেও স্ট্যান্ডিং টিকিট নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমরা সবাই এত বেশি ক্লান্ত যে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো শক্তি কারোই অবিশিষ্ট ছিল না। বাসে যাওয়ার চেয়ে ট্রেনে যাত্রা তুলনামূলক আরামদায়ক হওয়ায় পরবর্তী ট্রেনের টিকিট কাটি। আজ দুপুর ৩টায় আমাদের ট্রেন।'

রুবায়াতের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন সুমি থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার পর কেটে গেছে পুরো ৪৮ ঘণ্টা। গন্তব্য ওয়ারশতে পৌঁছাতে তাদের সামনে এখনও ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার যাত্রাপথ অপেক্ষা করছে।

যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ১৪ দিন কাটিয়ে মৃত্যুর মুখামুখি থাকা এই ৯ বাংলাদেশি বেঁচে ফিরতে পারবেন সেই প্রত্যাশাই করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত সব বাধা পেরিয়ে আজ তারা পোল্যান্ডে এসেছেন এবং আজই পৌঁছে যাবেন ওয়ারশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে।

ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যারা বেড়িয়ে এসেছেন অনিশ্চয়তায় পরেছে তাদের শিক্ষাজীবন। তাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাদের কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষাজীবন শেষ করার কথা ছিল। দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা তাদের সর্বস্ব সেখানেই ফেলে এসেছেন।

তাদের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা বলেন, 'ব্যবসায়ীদের একজন আছেন যিনি তার সর্বস্ব ইউক্রেনে ফেলে এসেছেন। তিনি কী করবেন সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, আমি এখনও কিছু চিন্তা করতে পারছি না, আরেকটু সময় লাগবে সিদ্ধান্ত নিতে। একেকজনের জীবন যেন একেকটা সিনেমার মতো হয়ে গেছে। তারা তাদের বাড়ি, গাড়ি, অর্থ সব ফেলে এক কাপড়ে চলে এসেছেন। কোটি কোটি টাকার মালিক ছিলেন, অথচ শেল্টার হাউজে থাকাকালীন সন্তানের জন্য খাবার কিনতেও তাদের বেগ পেতে হয়েছে। এই যুদ্ধের কারণে চোখের পলকে তারা যেন নিঃস্ব হয়ে গেছেন।'

শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকে চাইছেন তাদের ক্রেডিট ট্রান্সফার করে ইউরোপের কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে।'

গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টার দিকে ইউক্রেনের সুমি শহরে আটকে থাকা নিজেদের নাগরিকদের সঙ্গে এই ৯ বাংলাদেশিকে রেডক্রসের সহায়তায় উদ্ধার করেছে ভারতীয়রা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য টেলিফোনে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।

সুমি শহর থেকে বাস যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে গতকাল রুবায়াত হাবিব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, '৫০টি বাসের প্রতিটিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিলাম। সারাক্ষণ ছিল গুলি-বোমা-মৃত্যুর আতঙ্ক।'

রুবায়াত, তার স্ত্রী এবং ২ সন্তানের সবার বসার জন্য আসন ছিল না বাসে।

'দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা যাত্রার পুরোটা সময় আমি ও আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে থেকেছি। ২ সন্তানকে সিটে বসিয়ে পথ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় কেটেছে ১২ ঘণ্টা। বেঁচে থাকার আনন্দের কাছে এই কষ্ট যেন কিছুই না। বেঁচে থাকব, একটা সময়ে তো এমন আশাই করতে পারছিলাম না,' বলছিলেন রুবায়াত হাবিব।

Comments

The Daily Star  | English

JnU students vow to stay on streets until demands met

Jagannath University (JnU) students tonight declared that they would not leave the streets until their three-point demand is fulfilled

7h ago