রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভাড়াটে সৈনিকের চাহিদা বাড়ছে

অভিনব এক অনলাইন চাকরির বিজ্ঞাপন। নিমিষেই নজর কাড়ে বেতনের পরিমাণ।
ছবি: সংগৃহীত

অভিনব এক অনলাইন চাকরির বিজ্ঞাপন। নিমিষেই নজর কাড়ে বেতনের পরিমাণ।

'গোপন মিশনে ইউক্রেন যেতে ইচ্ছুক এবং একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন এমন সাবেক সেনা সদস্য আবশ্যক। বেতন দৈনিক সর্বোচ্চ ২ হাজার ডলার বা ১ হাজার ৫২৩ পাউন্ড (প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা) হতে পারে, আর সঙ্গে থাকছে উপরি বা বোনাসের সম্ভাবনা।'

এ অর্থ পেতে হলে যা করতে হবে তা হলো, ধারাবাহিকভাবে অবনতি হতে থাকা ইউক্রেনে সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু থেকে এক বা একাধিক পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করে নিয়ে আসতে হবে। গোপন মিশন বলতে এই উদ্ধার কার্যক্রমকেই মূলত বোঝানো হয়েছে। 

ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপানের ছবি। সংগৃহীত

শুনেই মনে হতে পারে হলিউডের কোনো অ্যাকশন মুভি বা ৮০র দশকের দ্য এ-টিম সিরিজের স্ক্রিপ্ট। ২০২০ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া সিনেমা এক্সট্রাকশনের কথাও মনে পড়ে। যেখানে অপহৃত এক কিশোরকে উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশে আসেন অস্ট্রেলিয়ার একজন ভাড়াটে সেনা।

তবে এই বিজ্ঞাপনে কোনো খাদ নেই। সাইলেন্ট প্রফেশনালস নামের একটি চাকরির ওয়েবসাইটে এ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, বেসরকারি সামরিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পিএমসির (প্রাইভেট মিলিটারি কন্ট্রাকটর) চৌকস 'ভাড়াটে' যোদ্ধা বা মার্সেনারিদের আকৃষ্ট করা।

কারা এই পিএমসি বা মার্সেনারি

সাধারণত সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে এ সংস্থাগুলো পরিচালিত হয়। তাদের প্রায় সবারই থাকে অস্ত্র চালনা ও জটিল সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ ধরনের যোদ্ধার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশে বেসরকারি মালিকানায় কোনো সামরিক বাহিনী গঠনের অনুমতি না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এ ধরনের অনেক সংস্থা আছে। কিছু প্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগে নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহ করে, কিন্তু তাদের সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় না।

পিএমসি বা বেসরকারি সামরিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে ইউক্রেনে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও রসদের সরবরাহ থেকে শুরু করে এক্সট্রাকশান বা উদ্ধার অভিযান।

কানাডিয়ান আমেরিকান বেসরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠান বিশেষজ্ঞ রবার্ট ইয়ং পেলটন বিবিসিকে জানান, বাজারে এখন এ ধরনের উদ্ধার কাজের জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর চাহিদা অনেক বেড়েছে।

আগের বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যায়, এ ধরনের ভাড়াটে সৈনিকদের অংশগ্রহণে চলমান যুদ্ধে ভুল ভ্রান্তি এবং বিভিন্ন ধরনের গোলযোগের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

ইউক্রেনে পিএমসির চাহিদা

পশ্চিমের দেশগুলো থেকে অনেক স্বেচ্ছাসেবী ইউক্রেনে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন। তাদের প্রত্যাশা, ইউক্রেনের যোদ্ধাদের মতোই হবে তাদের সম্মানী। কিন্তু এর বাইরেও সাইলেন্ট প্রফেসশনালসের মতো বিভিন্ন চাকরির ওয়েবসাইটে ব্যক্তিগত কারণে মানুষ নিরাপত্তা সেবা খুঁজছেন।

চাকরির ওয়েবসাইটগুলোতে বিজ্ঞাপনদাতাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। পেলটনের মতে, ইউক্রেনে আটকেপড়া ব্যক্তিদের বের করে আনার জন্য ৩০ হাজার ডলার থেকে শুরু করে ৬০ লাখ ডলার মূল্যমানের চুক্তিও করা হচ্ছে। সহায়-সম্পত্তিসহ পুরো পরিবারকে বের করে আনতে হলে চুক্তির অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়।

ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে মার্কিন গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা পরামর্শক সংস্থা মোজাইক। প্রতিষ্ঠানটির সিইও টনি শিয়েনা জানান, কাজের জটিলতা অনুযায়ী উদ্ধার অভিযানের মূল্যের পরিবর্তন হয়।

তিনি জানান, বেশি মানুষকে উদ্ধার করার প্রয়োজন হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। শিশু ও পরিবারের সবাইকে একইসঙ্গে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে জটিলতা বেশি থাকে। কোন পথে এবং কীভাবে তাদের বের করে আনা হবে, সেটার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে।

টনি আরও জানান, তারা বেসরকারি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষদের জন্য কাজ করছেন।

তিনি দাবি করেন, একটি দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সংস্থাটি ইউক্রেন থেকে তাদের দেশের নাগরিকদের বের করে আনতে চায়।

পিএমসি আগেও কার্যকর ছিলেন, এখনো আছেন

এর আগেও বিভিন্ন যুদ্ধ ও সংঘর্ষে ভাড়াটে সৈনিকদের কাজে লাগানো হয়েছে। নাইন ইলেভেন বিপর্যয়ের পর ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধেও পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের সরকার ও বেসরকারি সংস্থা তাদেরকে কাজে লাগিয়েছে।

ইরাকে যুদ্ধাবস্থা যখন তুঙ্গে, তখন হাজারো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সৈনিকরা সেখানে কার্যকর ছিলেন। বহুল আলোচিত মার্কিন প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকওয়াটার তার মধ্যে অন্যতম। তাদের কাজের মধ্যে ছিল সশস্ত্র অভিযান, যেমন সরকারি বহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সামরিক ঘাঁটিতে সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করাসহ আরও অনেক কিছু। ২০০৭ এ বাগদাদে ব্ল্যাকওয়াটারের এক হামলায় ১৪ জন বেসামরিক ইরাকি নাগরিক মারা গেলে বিষয়টি বেশ সমালোচিত হয়।

পূর্ব ইউরোপেও ভাড়াটে সৈনিকের ব্যবহার পুরনো নয়। সাবেক যুগোস্লাভিয়া ভাঙার সময় বসনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার বাহিনীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মদদে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানো হয়।  

অ্যারোস্পেস অ্যান্ড ডিফেন্স নিউজের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ এ বেসরকারি সামরিক ও নিরাপত্তা খাতের মূল্যমান প্রায় ২২৪ বিলিয়ন ডলার। এটি ২০৩০ নাগাদ ৪৫৭ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ক্রিস্টোফার মেইয়ার জানান, তিনি ইরাক যুদ্ধে পিএমসিদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি মনে করেন, পশ্চিমের সামরিক ঠিকাদারদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আইন, নীতিমালা ও নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারা তাদের দেশের সরকারের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে দায়বদ্ধ থাকে।

মেইয়ার আরও জানান, পিএমসিদের দায়িত্ব যুদ্ধ করা নয়। তাদের কাজ মানুষ, স্থাপনা ও সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া। তাদের 'ভাড়াটে সৈনিক' বলতেও তিনি রাজি নন। 

তবে অনেক বিশেষজ্ঞ ইউক্রেনে এ ধরনের বেসরকারি সামরিক যোদ্ধাদের ব্যবহার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন

আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে পিএমসি হিসেবে কাজ করা সাবেক মার্কিন প্যারাট্রুপার শন ম্যাকফেইট জানান, যিনি পিএমসি হতে পারেন, তিনি চাইলে মার্সেনারিও হতে পারেন।

দুটির মাঝে আসলে তেমন কোনো পার্থক্য নেই, বলেও মনে করেন তিনি। 

পিএমসির সংখ্যা বাড়লে গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা বেড়ে যেতে পারে, সতর্ক করেন শন।

ইউক্রেন প্রেক্ষাপট

সম্প্রতিকালে অভিযোগ এসেছে, ইউক্রেনের মাটিতে রুশ ভাড়াটে সৈনিকরাও সামরিক অভিযানে অংশ নিচ্ছেন।

তবে যুক্তরাজ্যের সাবেক স্পেশাল ফোর্স কর্মকর্তা এবং পিএমসি প্রতিষ্ঠান একজিকিউটিভ আউটকামস এবং স্যান্ডোলাইনের প্রতিষ্ঠাতা সাইমন ম্যান জানান, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য পশ্চিমা পিএমসি ব্যবহারের সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ এতে আইনি জটিলতা রয়েছে।

তবে উদ্ধার অভিযানে পিএমসির ব্যবহারের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন বলে জানান সাইমন।

উদ্ধার অভিযানে জনপ্রতি ১০ হাজার পাউন্ড করে নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

তবে কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন, অর্থ ব্যয় করে ইউক্রেনে উদ্ধার অভিযানে সাফল্যের কোনো নিশ্চয়তা নেই এবং অনেকে নিজেদের অভিজ্ঞ যোদ্ধার পরিচয় দিয়ে প্রতারণাও করছেন।

যুক্তরাজ্যের সাবেক সেনা ও নিরাপত্তা পরামর্শক অরল্যান্ডো উইলসন ইউক্রেন যুদ্ধে পিএমসির ব্যবহারে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, 'আমি এ মুহূর্তে বেসরকারি উদ্যোগে ইউক্রেনে কোনো অভিযান পরিচালনার সম্ভাবনা দেখি না।'

'যে পক্ষই আপনাকে খুঁজে পাবে, সেই ধরে নেবে আপনি অপর পক্ষের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছেন এবং সেখানেই ঘটনার ইতি', যোগ করেন উইলসন।

অর্থাৎ, এ ধরনের অভিযান কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না, যিনি টাকা দিচ্ছেন, তার কাজও হবে না, আর যিনি নিচ্ছেন, তিনি কাউকে উদ্ধার করা তো দূরে থাক, বেঁচে ফিরতে পারবেন কি না, সেটারও কোনো ঠিক নেই।

পিএমসি যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে পারে

আজ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ১৬তম দিন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বিশ্ববাসীকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন তাদের কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে যুদ্ধ করতে। অনেক স্বেচ্ছাসেবক ইতোমধ্যে কিয়েভের পথে রওনা হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ব্যক্তিগত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাচ্ছেন উপহার হিসেবে। বৃহস্পতিবার সকালে রুশ বাহিনীর হামলায় আক্রান্ত হয়েছে একটি শিশু হাসপাতাল। সামনে যুদ্ধ আরও ভয়াবহ হতে পারে। অনেকেরই আপনজন আটকে আছেন ইউক্রেনের বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের মধ্যে যারা অবস্থাপন্ন, তারা সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেদের উদ্যোগে পিএমসি বা ভাড়াটে সৈনিকদের কাজে লাগাচ্ছেন। হয়তো আগামীতে ইউক্রেন সরকারও তাদের কাজে লাগাতে পারে।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন জানা অজানা ও নজিরবিহীন প্রভাবকের কারণে পূর্ব ইউরোপে আধুনিক যুগের এই সংঘর্ষ বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। সার্বিকভাবে, ভাড়াটে সৈনিকদের অংশগ্রহণে এ জটিলতা আরও অনেকাংশে বেড়ে যাতে পারে বলেই ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে তারা যদি উদ্ধার কার্যক্রমের পাশাপাশি রুশ বাহিনীর বিপক্ষে সম্মুখ লড়াইয়ে অংশ নেয়।

উল্লেখ, অনেক পিএমসির সামরিক সক্ষমতা বিশ্বের অনেক দেশের সরকারি বাহিনীর চেয়েও বেশি শক্তিশালী।

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago