যে কারণে আলোচনায় ইউক্রেনের বুচা শহর
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিকটবর্তী শহর বুচা। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটে কয়েকদিন ধরে ঘুরেফিরে এ শহরটির নামই বারবার উঠে আসছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যায় রুশ বাহিনী। ৫ সপ্তাহ তুমুল লড়াইয়ের পর বুচা ছাড়ে রাশিয়ান সেনারা। এর কয়েকদিন পর গত শনিবার তাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিক হত্যার অভিযোগ আনে ইউক্রেন।
বেসামরিক নাগরিক হত্যার আলামত
শনিবার বুচার মেয়র আনাতোলি ফেদোরুক বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে শহরের রাস্তায় বেসামরিকদের মরদেহ পড়ে থাকার তথ্য জানান। তিনি বলেন, নিহতদের অনেকের হাত পেছনে বাঁধা। মাথার পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাদের।
একইদিনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বুচার ভয়াবহ সব ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হয়, যেখানে একটি রাস্তায় অন্তত ২০ জন বেসামরিক মানুষের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সাংবাদিকরা বুচায় গণকবরেরও সন্ধান পান। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, রুশ বাহিনী শহরটিতে হামলা শুরু করার প্রথম দিক থেকেই এখানে মরদেহ কবর দেওয়া শুরু হয়েছিল। সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সাংবাদিকরা গণকবরে অন্তত এক ডজন মরদেহ দেখতে পান। তবে নিহতদের জাতীয়তা নিশ্চিত করা সিএনএনের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
স্থানীয়রা সিএনএনকে জানান, বুচার গণকবরে প্রায় ১৫০ জনকে কবর দেওয়া হয়েছে। তবে বুচার মেয়রের মতে, সেখানে ৩০০ জনের মতো বেসামরিক মানুষের মরদেহ থাকতে পারে।
এরপর গত রোববার ইউক্রেনের শীর্ষ প্রসিকিউটরের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, রাশিয়ার 'সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের' তদন্ত করতে গিয়ে ইউক্রেন বুচা শহরে ৪১০টি মরদেহ পেয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা এতটাই মর্মাহত যে, তারা কথাও বলতে পারছেন না।
বুচার এ ঘটনাকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার 'গণহত্যা' ও 'যুদ্ধাপরাধ' বলে অভিহিত করেছেন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবাও একে 'গণহত্যা' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে বুচায় রাশিয়ার 'যুদ্ধাপরাধ' তদন্ত ও এ বিষয়ে প্রমাণ সংগ্রহের আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
নিন্দার ঝড় ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞার আহ্বান
বুচার ভয়াবহ ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সারাবিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এ হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানাতে শুরু করে।
রয়টার্স, সিএনএন ও বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনসহ পশ্চিমা নেতারা এ ঘটনাকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। 'যুদ্ধাপরাধের' তদন্তের জন্য ইইউ বুচায় একটি তদন্ত দল পাঠাবে বলে জানিয়েছেন ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইন।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, বুচায় বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন।
ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ছবিগুলো 'বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে এমন নৃশংসতা দেখায়, যা আমরা কয়েক দশক ধরে ইউরোপে দেখিনি।'
বুচার ঘটনাকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে চিহ্নিত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ইউক্রেনের চেরনিহিভ, খারকিভ ও কিয়েভে রাশিয়ার সেনাদের যুদ্ধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে সংস্থাটি।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, জাপান থেকেও নিন্দা এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান এসেছে। রুশ রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে লিথুয়ানিয়া। রাশিয়াকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য রাশিয়া ও এর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যেন মূল্য দিতে হয়, তা নিশ্চিত করতে মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'রাশিয়ান নৃশংসতা গণহত্যার স্তরে পৌঁছেছে কি না' সেই প্রমাণ এখনো তারা পাননি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা অন্য কোনো স্থানে এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
এদিকে জো বাইডেন বুচার ঘটনাকে 'যুদ্ধাপরাধ' অভিহিত করে বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি।
অভিযোগ অস্বীকার করছে রাশিয়া
বুচায় বেসামরিকদের হত্যার অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে রাশিয়া। রুশ সংবাদমাধ্যম আরটির প্রতিবেদন অনুসারে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, বুচা শহরে রাশিয়ার সেনাদের যুদ্ধাপরাধে জড়ানোর অভিযোগ সত্য নয়।
ইউক্রেনের দেওয়া তথ্য নিয়ে সংশয় আছে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, রাশিয়ান সামরিক বিশেষজ্ঞরা এসব ভিডিওতে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছেন। বুচার ঘটনা এবং এ ঘটনার সময়ের সঙ্গে ইউক্রেনের দাবির কোনো মিল নেই বলে উল্লেখ করেন পেসকভ।
'পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে গুরুতর। আমরা বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন মিথ্যা অভিযোগের বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করেন, বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নেন এবং আমাদের যুক্তিগুলো অন্তত শোনেন', তিনি বলেন।
এদিকে সিএনএনের প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, রাশিয়া বুচার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে।
রাশিয়ার তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান আলেকজান্ডার বাস্ট্রিকিন তার সংস্থাকে বুচার বেসামরিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তদন্ত কমিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, 'আমাদের তথ্য বলছে, রাশিয়ান সামরিক কর্মীদের সুনামহানি করার জন্য ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বেসামরিক গণহত্যার প্রমাণ হিসেবে বুচা শহরের ভিডিওপশ্চিমা গণমাধ্যমকে দিয়েছে।'
শান্তি আলোচনায় কি বুচার ঘটনার প্রভাব পড়বে?
মস্কো-কিয়েভ এখন পর্যন্ত বেশ কয়েক দফায় শান্তি আলোচনায় বসেছে। বুচার ঘটনায় ২ পক্ষের আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটবে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।
সোমবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বুচা পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি বলেন, ইউক্রেনে রুশ সেনাদের এই নৃশংসতা দেখার পর রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালানো কিয়েভের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।
তবে এ বিষয়ে রাশিয়ার অবস্থান জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ।
Comments