বাঙালি ও বাংলার উৎসবের দিন চৈত্র সংক্রান্তি

চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। ছবি: সংগৃহীত

চৈত্র সংক্রান্তি বা চৈত্র মাসের শেষদিন। বাংলা মাসের সর্বশেষ দিনটিকে সংক্রান্তির দিন বলা হয়। একসময় বাংলায় প্রতিটি ঋতুরই সংক্রান্তির দিনটি উৎসবের আমেজে পালন করতো বাঙালি। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সে উৎসব। তবে আজো বাঙালি আগলে রেখেছে সংক্রান্তির দুটি উৎসবকে। একটি চৈত্র সংক্রান্তি, অপরটি পৌষ সংক্রান্তি।  

কথিত আছে, বাংলা পঞ্জিকার চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়েছিল তিক্রা নক্ষত্র হতে। পুরাণে আছে, সাতাশটি নক্ষত্রের নামে দক্ষ রাজ সুন্দরী কন্যাদের নামকরণ করেছিলেন। তার দু'কন্যার নাম যথাক্রমে চিত্রা ও বিশাখা। এক মাস ব্যবধানে জন্ম বলে এই দুই কন্যার নাম থেকে জন্ম নিল বাংলা দুই মাস; যথাক্রমে চৈত্র ও বৈশাখ।

চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরু। বাঙালির সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব পালিত হয় এই দুই দিনে। তবে দুয়ের মধ্যে উৎসবের তালিকায় চৈত্র সংক্রান্তির পাল্লা ভারী। বাংলা বর্ষের সর্বাধিক উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে বাঙালি কিংবা বাংলার মানুষ এই দিনকে কেন্দ্র করে উৎসব পালন করে। কখনো ধর্মীয় বিশ্বাস, কখনো আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আর লোক লোকায়িত উৎসবের ধ্বনি পাওয়া যায় এই একটি দিনকে ঘিরে।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বাঙালি ও বাংলার চৈত্র সংক্রান্তির দিনের তেমনই কিছু উৎসবের বর্ণনা রইলো।

শাকান্ন। ছবি: সংগৃহীত

শাকান্ন

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে এককালে শাকান্ন পালিত হতো। এদিন সকাল বেলাতেই বাড়ির চারপাশের জলা, জংলা, ঝোপঝাড় থেকে শাক তুলে আনতো বাড়ির বউ-ঝিরা। মজার ব্যাপার হলো এই শাক কিন্তু আবাদি বা চাষ করা হলে হবেনা। হতে হবে অনাবাদী। এমন চৌদ্দ পদের শাক দিয়েই সেদিন দুপুরের আহার হতো। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এই আহার ছাড়া বাড়িতে কোনো মাছ মাংসের পদ রান্না হতো না। আজো বাংলার কোনো কোনো গ্রামে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে শাকান্ন উৎসব পালিত হয়।  

চৈত্র সংক্রান্তির শরবত

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে গ্রামের বাড়িতে খাওয়া হতো গমের ছাতু, দই ও পাকা বেল সহযোগে এক বিশেষ শরবত। এই শরবতেই প্রাণ জুড়িয়ে নিতো সংক্রান্তির উৎসবে যোগ দেওয়া সবাই। কেবল তাই নয়, সংক্রান্তির দিন গ্রামের হাটে কোনো কোনো দোকানে বিক্রেতারা ক্রেতাদের এই শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।

চৈত্র সংক্রান্তির তালতলার শিরনি

এককালে চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে কেনা হতো চাল, গুঁড়। কোনো বাড়ি থেকে নেওয়া হতো দুধ। সংগৃহীত সেই দুধ, চাল, গুঁড় গাঁয়ের সবচেয়ে উঁচু গাছের নিচে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানেই হাঁড়িতে চড়িয়ে পাক হতো শিরনি। এই শিরনি খেতে গাঁয়ের মানুষ জমায়েত হতো সে গাছের তলে। বেশিরভাগ সময়ই তালগাছ উঁচু হওয়ায় তালগাছের নিচে শিরনি রান্না হতো বলে লোকমুখে সেই খাবারের নাম ছিল তালতলার শিরনি।

চৈত্র সংক্রান্তির লোকজ নামাজ

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে একসময় গ্রাম বাংলার মুসলমানদের মধ্যে নামাজের চল ছিল। এদিনে গাঁয়ের মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রামের খোলা মাঠে কিংবা উন্মুক্ত প্রান্তরে জামাতের সহিত নামাজ আদায় করতেন। এই নামাজের পর হতো বিশেষ মোনাজাত। এই মোনাজাতের উদ্দেশ্য ছিল খরা থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে নিষ্কৃতি লাভ এবং একই সঙ্গে আসন্ন নতুন বছর যেন শুভ হয় সেই প্রার্থনা।

চড়ক উৎসব। ছবি: সংগৃহীত

চৈত্র সংক্রান্তির লোকজ চড়ক পূজা

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের লোকজ পূজার চল ছিল। চৈত্র সংক্রান্তি ও এর আগের কয়েকদিন মিলে পালিত হতো চড়ক পূজা। সন্তান প্রাপ্তি, দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ ও মনের বাসনা পূরণের আশায় পূজা করা হতো। পূজার কয়েকদিন আগে থেকেই ব্রত এবং সংযম পালন করতেন ভক্তরা। এরপর একজনকে হনুমানের মতো লম্বা লেজ এবং মাথায় লালরঙের ফুল দিয়ে সাজানো হতো। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে চড়ক পূজা পালন করা হয়। প্রথমভাগকে বলা হয় গিরি সন্ন্যাস, দ্বিতীয়ভাগে বাবর সন্ন্যাস, তৃতীয়ভাগে নীল পূজা, চতুর্থভাগে হাজরা পূজা ও দেবতার ভর। শেষভাগে চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করে ভক্তি প্রদর্শনের জন্য ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার ওপর ঝাঁপ দিয়ে মাথা নিচে রেখে ঝুলে থাকেন। এরপর বাণ সন্ন্যাস, বেত্র সন্ন্যাস ও বড়শি সন্ন্যাস পালন করে এই পূজা শেষ হয়। একসময় বাংলার প্রায় সকল অঞ্চলে পালিত হতো চড়ক পূজা। চড়ক পূজা উপলক্ষে বেশীরভাগ গ্রামে আজো বসে সপ্তাহব্যাপী মেলা।

চৈত্র সংক্রান্তির লোকজ নীল পূজা, নীল উৎসব

চড়ক পূজার আগের দিনই পালিত হতো নীলপূজা। এটি ছিল চড়ক পূজার অন্যতম অনুষঙ্গ। যদিও কালের বিবর্তনে পুরো চড়ক পূজার বদলে একাংশ নীল পূজাই পালিত হয়। নীল পূজার জন্য নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা পূজার সময়ে নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নীলের গানকে বলা হয় অষ্টক গান। ঐদিন সন্ধ্যাবেলায় সন্তানবতী হিন্দু রমণীরা সন্তানের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপূজা করে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন। নীল পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীল নাচ এবং শিবের গাজন।

শিবের গাজন। ছবি: সংগৃহীত

শিবের গাজন

কেবল চৈত্র সংক্রান্তিতেই শিবের গাজন পালিত হয়। শিবের গাজনের মধ্য দিয়েই শেষ হয় চড়ক পূজা। চৈত্র সংক্রান্তি ছাড়া বছরের অন্য সময় পালিত হওয়া শিবের গাজনকে বলা হয় হুজুগে গাজন।

গম্ভীরা পূজা

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বরেন্দ্র অঞ্চলে পালিত হয় গম্ভীরা পূজা।

খেজুরভাঙ্গা উৎসব। ছবি: সংগৃহীত

খেজুর ভাঙ্গা উৎসব

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পালিত হয় খেজুরভাঙ্গা উৎসব। এই উৎসবে সন্ন্যাসীরা মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী নিত্যগীতি সহকারে মাগন করেন। পূজার লগ্নে সারাদিন উপবাস পালন করে ভক্তরা। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে নারীরা একটি নিদিষ্ট খেজুরগাছের গোড়ায় দুধ এবং ডাবের জল ঢেলে পূজা করেন। পূজা শেষে সন্ন্যাসী দলনেতা গামছা গায়ে চড়িয়ে খেজুরগাছকে প্রণাম করে খালি গায়ে গাছে উঠেন। এরপর সন্ন্যাসী দলের বাকিরা কাঁটাযুক্ত খেজুর পাতার উপরে দাঁড়িয়ে নাচে। গাছে উঠা সন্ন্যাসী দলনেতা খেজুর গাছ থেকে খেজুর ভেঙে ভক্তদের মাঝে বিলাতে থাকেন। সেই খেজুর খেয়ে উপোস ভঙ্গ করেন ভক্তরা।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বৈসাবি উৎসব

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বাঙালি ছাড়াও উৎযাপন করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রধান উৎসব বৈসাবি পালিত হয় চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষের দিনে। বৈসাবি'র 'বৈ' এসেছে ত্রিপুরাদের 'বৈসু' থেকে, 'সা' এসেছে মারমাদের 'সাংগ্রাই' থেকে এবং 'বি' শব্দটি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের 'বিজু' থেকে।

পাজন। ছবি: সংগৃহীত

বিজু উৎসব

চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান উৎসব বিজু পালিত হয় চৈত্রসংক্রান্তির দিনে। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালিত হয় ফুলবিজু। চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালন করা হয় মূলবিজু। চৈত্র সংক্রান্তি বা মূলবিজুর দিনে চাকমাদের ঘরে ঘরে বিভিন্ন সব্জির সংমিশ্রণে তৈরি হয় সুস্বাদু পাজন। এদিন বাড়ি বাড়ি আত্মীয়স্বজনেরা বেড়াতে আসে। চাকমা ও তঞ্চইঙ্গা সম্প্রদায়ের ধারণা, বছরের সর্বশেষ দিনে ভালো খাবার খাওয়া পুণ্যের কাজ। নববর্ষের দিন তারা পালন করে গজ্যা পজ্যা বা গড়িয়ে পড়ার দিন হিসেবে।

বৈসু উৎসব

চৈত্র সংক্রান্তির শেষ দুদিন ও নববর্ষের প্রথম দিন ত্রিপুরা সম্প্রদায় পালন করে তাঁদের প্রধান উৎসব বৈসু। চৈত্রমাসের সর্বশেষ দুদিনকে ত্রিপুরারা যথাক্রমে বলে 'হারি বৈসু' ও 'বিসুমা'। হাড়ই বৈসুর দিনে পাহাড় থেকে ফুল এনে ঘর সাজায় তাঁরা। আর বিসুমা বা সংক্রান্তির দিন পালন করে খাবার উৎসব। এদিন নানা ফলমূল ছাড়াও, নানা পিঠা ও সুস্বাদু পাজন তৈরি করে ত্রিপুরারা। আর নববর্ষের দিন তারা পালন করে বিসিকতাল। এদিন তারা প্রার্থনা এবং পানি খেলা উৎসব পালন করে।

সাংগ্রাই উৎসব  

বছরের শেষ দুদিন ও নববর্ষের প্রথম দিনে মারমারা পালন করে সাংগ্রাই উৎসব। এদিন পিঠা, পাচন সহ নানাবিধ খাবারের আয়োজন করে মারমারা। সংক্রান্তির আগের দিন মারমারা পালন করে পাঃংছোয়াই বা ফুল ছেঁড়ার দিন হিসেবে। পাঃংছোয়াই'য়ের রাতে পাহাড় থেকে ফুলগুলো ছিঁড়ে বাড়িগুলো সাজানো হয়। তবে সেসময় মারমারা সাদা ফুলগুলো রেখে দেয়। সংক্রান্তির দিন ফুল ছেঁড়ার উৎসবকে বলা হয় সাংগ্রাই পাঃং বা সাদা ফুল তোলার উৎসব। এই ফুল ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে নানা লোককথা প্রচলিত আছে সাংগ্রাইদের মাঝে।

 

তথ্যসূত্র:

পার্বত্য চট্টগ্রামের মেলা উৎসব এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ: শরদিন্দু শেখর চাকমা

বাংলাদেশের উৎসব: মুনতাসির মামুন

বাংলাদেশের আদিবাসী (প্রথম খণ্ড): মঙ্গল কুমার চাকমা

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Touhid Hossain Rohingya statement

Rohingya repatriation unlikely amid Myanmar’s civil war: foreign adviser

He highlights the 2017 mass exodus—prompted by brutal military crackdowns was the third major wave of Rohingyas fleeing Myanmar

24m ago