বাঙালি ব্যবসায়ীর মন

বাংলাদেশে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের প্রকৃতি, ব্যবহার, লেনদেনের ধরন দেখলে মনে হবে এরা চাকরি বা রাজনীতি না করেও দুর্নীতিবাজ, দেশ না চালিয়েও স্বৈরাচার, আর ডাকাতি না করেও লুটেরা হয়ে আছে। ব্যবসা যে শুধু টাকা বানানোর পন্থা না, বরং এটা যে একটা পেশা, এই মনোভাব বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরল। সাম্প্রতিক ৩টি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি ব্যবসায়ীর মনন বা আচরণ ব্যাখ্যা করা যাক।
রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেট। স্টার ফাইল ছবি

বাংলাদেশে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের প্রকৃতি, ব্যবহার, লেনদেনের ধরন দেখলে মনে হবে এরা চাকরি বা রাজনীতি না করেও দুর্নীতিবাজ, দেশ না চালিয়েও স্বৈরাচার, আর ডাকাতি না করেও লুটেরা হয়ে আছে। ব্যবসা যে শুধু টাকা বানানোর পন্থা না, বরং এটা যে একটা পেশা, এই মনোভাব বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরল। সাম্প্রতিক ৩টি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি ব্যবসায়ীর মনন বা আচরণ ব্যাখ্যা করা যাক।

ঘটনা ১: অতীতের পেয়াজ, কাঁচা সবজির মতো সম্প্রতি দেশে কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ানো হয়েছে তেলের দাম। সয়াবিন তেল একটা আন্তর্জাতিক পণ্য হওয়ায় পৃথিবীর সব দেশেই এটি বহুল ব্যবহৃত। সিন্ডিকেট করে এই তেলের দাম বাড়িয়ে কয়েক দিনের মধ্যে হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। তেলের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে তারা অদ্ভুত সব যুক্তি দেখান। যেমন: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলের দাম বেশি, জোগান কম ইত্যাদি। তাদের এমন যুক্তির সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকলেও, মিথ্যা যুক্তির বয়ানে তারা সিদ্ধহস্ত। দাম বাড়ানোর জন্য এ দেশে কারণ লাগে না। শুধু চাহিদা বাড়লেই হলো। তাই রোজার সময় মানুষের চাহিদাকে জিম্মি করে তারা তেল, চিনি, বেগুন, তরমুজ সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দেন। অথচ এত বড় মুসলিম অধ্যুষিত দেশে রোজার সময় মানুষের জীবনযাত্রার সুবিধার্থে যেখানে ব্যবসায়ীদের লাভ কম করার কথা, সেখানে এ দেশের অতি-মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যে মানুষের জীবন হয়েছে অতিষ্ঠ।    

ঘটনা ২: সম্প্রতি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের তাণ্ডবলীলার কারণ হিসেবে খাবার রেস্টুরেন্টের হাতাহাতির ঘটনাকে বড় করে দেখালেও, এর আড়ালে আছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ক্রেতাদের দীর্ঘদিনের এক সাপে-নেউলে সম্পর্ক। দাম-দর করতে গেলে দুর্ব্যবহার, নারী ক্রেতাদের সঙ্গে অসম্মানজনক ভাষার ব্যবহার, প্রকৃত দামের চেয়ে বহু গুণে একটি জিনিসের দাম চাওয়া ইত্যাদি। এমন অভিজ্ঞতা মোটামুটি প্রায় সবারই, যারা এই এলাকার মার্কেটগুলোতে কেনাকাটা করেন বা করেছেন। আসলে এসব ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের অন-টাইম কাস্টমার ভাবেন, যেন একবারে তাদের কাছ থেকে যেকোনোভাবে টাকা নিতে পারলেই হলো। অথচ সততা আর সদ্ব্যবহার যে ব্যবসার সবচেয়ে বড় পুঁজি, তা তাদের ভাবনাতে থাকে না আদৌ।

ঘটনা ৩: জাতীয় ভোক্তা অধিকার দপ্তর থেকে ঈদের মার্কেট আর শপিংমলগুলোতে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, একটি পণ্যের দাম দ্বিগুণ, ৩ গুণ, ৪ গুণ বাড়িয়ে তারা পণ্যের ওপর বিভিন্ন ডিসকাউন্টের নামে ব্যবসা চালাচ্ছেন। যদিও বর্তমানের অভিযানে কিছু জায়গায় এমন জোচ্চুরি ধরা পড়লেও, এমনটি এ দেশের ব্যবসায়ীরা করে চলেছেন বহুদিন ধরে। তবে এবার অভিযান চালানোর কারণে, বিভিন্ন চ্যানেলের ক্যামেরায় এগুলো ধরা পড়ছে। অথচ হাতেনাতে ধরা পড়া সত্ত্বেও, নির্লজ্জ মিথ্যাচারে এমন দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে নেই একটুও। বাহারি নামের, আর চাকচিক্যে ভরা এসব দোকানগুলো ঈদ, পূজা আর পহেলা বৈশাখে এমন বাণিজ্য করতে মরিয়া হয়ে উঠে, যেন বছরে বাকি সময় মাছি মেরে কাটালেও তাদের কিছু যায় আসে না।  

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ধরন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাদের কোনো নৈতিক ব্যবসায়িক চিন্তা বা দূরদর্শিতা নেই। এ দেশের দুর্নীতির অভয়ারণ্যে তারাও চান শর্টকাটে টাকার মালিক হতে। তাই ব্যবসা তাদের কাছে গৌণ, আর অতি মুনাফাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তাই এ দেশের ব্যবসায়ীরা বেশিদিন তাদের কারবারি ধরে রাখতে পারেন না। তারা হঠাৎ করে আসেন, হঠাৎ করেই বিদায় নেন। হটকারীমূলক দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রিতে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের জুড়ি নেই। সাধারণ দোকানি থেকে দামি সুপারস্টোরেও চলে একই অবস্থা। কাস্টমার সার্ভিস, যেমন: কাস্টমারের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার, দামে গরমিল বা পণ্যে কোনো ত্রুটি থাকলে তা তাৎক্ষণিক সমাধান করা, পণ্য যুক্তিযুক্ত কারণবশত ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করে অন্য পণ্য বা মূল্য ফেরত, এসবের ধার আমাদের ব্যবসায়ীরা ধারতে চান না। তাদের এমন অনিয়ন্ত্রিত আচরণ পরিবর্তনে ব্যবসায়িক নেতৃত্বেরও কোনো চেষ্টা কোনোদিন লক্ষ্য করা যায়নি।

ব্যবসায়ীদের গঠনমূলক আচরণ দেখার বা বোঝার জন্য উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়ীদের দিকে তাকানোর দরকার নেই, প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, ব্যবসায়ীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যবসা করে আসছেন সততা আর তাদের বিশ্বস্ততাকে পুঁজি করে। অন্যদিকে, অসততা, দ্বিচারিতা, দুর্নীতি অন্যসব কিছুর মতো আমাদের ব্যবসা খাতকেও গিলে ফেলেছে। বিশাল এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে সরকারও হয়ে আছে খানিকটা অসহায়। কারণ সরকারেরে মন্ত্রী, এমপিদের একটা বড় অংশই আজ ব্যবসায়ী। আবার সরকারি মনিটরিং বডিগুলোতে থাকে জনবল ঘাটতি আর দুর্নীতি। তাই যুগের পর যুগ এমন অধর্মের ব্যবসা বঙ্গবাসীর জন্য অভিশাপ হয়েছে।        

এম আর ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Ex-public administration minister Farhad arrested

Former Public Administration minister Farhad Hossain was arrested from Dhaka's Eskaton area

2h ago