যেভাবে লেখা হলো ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে', 'আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন'— জনপ্রিয় এসব গানের গীতিকার কে জি মোস্তফা গতকাল (৮ মে রবিবার) মারা গেছেন। তিনি একজন প্রখ্যাত গীতিকার, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন।  ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। 

২০১৪ সালের ২৫জুন তার সঙ্গে কথা হয় জাতীয় প্রেসক্লাবে। প্রথম গান লেখার স্মৃতিসহ অনেক বিষয়ে কথা হয় সেদিন। তার স্মরণে গান নিয়ে অংশটুকু প্রকাশ কার হলো। 

আপনি অনেক কালজয়ী গানের রচিয়তা। কবে কীভাবে লিখেছেন 'তোমারে লেগেছে এত যে ভালো গানটি, প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মনে পড়ে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম ১৯৫৬ সাল। পড়াশোনার পাশাপাশি কবিতার্চচা ছিল আমার। তৎকালীন বিভিন্ন সাময়িকী ও দৈনিকের পাতায় কবিতা লিখতাম। প্রখ্যাত কবি ও মেধাবী ছাত্র আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও আমি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। তিনি আমার দু'বছরের সিনিয়র। অন্য অনেকের মতো আমিও তাঁর গুণমুগ্ধ। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, আমার কবিতায় গীতিময়তা খুব বেশি। গান লিখলে নাকি ভালো করতে পারবো। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই মূলত গান লেখার শুরু।

ভার্সিটিতে তখন সহপাঠী বন্ধুদের বেশ ক'জন সঙ্গীত চর্চা করতেন। তাদের অনেকেই আজ তারকা শিল্পী। মুস্তফা জামান আব্বসী, খন্দকার নুরুল আলম, কাজী আনোয়ার হোসেন, ফেরদৌসী বেগম, সৈয়দ আবদুল হাদী, নাজমুল হুদা বাচ্চু, আঞ্জুমান আরা বেগম প্রমুখ। বন্ধুবর মুস্তফা জামান আব্বাসী নিজেই সুর করে আমার লেখা একটি গান সর্বপ্রথম বেতারে প্রচার করেন। সেই থেকে গান লেখার প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকলো। কাঁচা হাতের লেখা সেইসব গান শিল্পীবন্ধুরা সুর করতেন এবং ভার্সিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। বেতারেও  কেউ কেউ গাইতেন। সেসময়  বেতার ছিল একমাত্র প্রচার মাধ্যম। গীতিকার হিসেবে বেতারে তালিকাভুক্ত হওয়া ছিল বেশ কঠিন এক পরীক্ষা। এটা ছিল তখন এক দুর্লভ স্বীকৃতি। এরই মধ্যে গীতিকার হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে।

সেই সুবাদে আচমকা আমন্ত্রণ এলো 'রাজধানীর বুকে' চলচ্চিত্রের গান লেখার জন্য। স্বনামধন্য পরিচালক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী। সুরকার রবীন ঘোষ। কণ্ঠশিল্পী উপমহাদেশের তৎকালীন গজল সম্রাট তালাত মাহমুদ। উয়ারীতে রবীন ঘোষদের গোলাপি রঙের দোতলা বাড়ি। অভিনেতা আজিম (নূরুল আজিম খালেদ রউফ) আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। আজিম ছিলেন রবীন ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

আমাকে ছবির সিকোয়েন্স বুঝিয়ে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সুরের ওপর কথা বসাতে বললেন। শুনে তো আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এতদিন যা কিছু লিখেছি, সে তো মনের খেয়ালে। এখন এ যেন এক অগ্নিপরীক্ষায়। সবিনয়ে আমি আমার অক্ষমতা জানালাম। কিন্তু রবীন ঘোষ নাছোড়বান্দা। ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। হারমুনিয়ামে বার বার সুরটা বাজিয়ে শোনাচ্ছেন। আমি ক্রমে নার্ভাস হয়ে পড়ছি। আমার সে কী অসহায় অবস্থা। যাহোক, কিছু একটা লিখতেই হবে। হোক বা না হোক। না হলে মুক্তি নেই। অবশেষে গানটার সুর ও সিকোয়েন্সের প্রতি কিছুটা মনোযোগ হলাম। যথাসম্ভব কাহিনীটা মাথায় রেখে সুরের ওপর কথা বসাতে চেষ্টা করলাম। প্রথম লাইন লিখলাম 'তোমারে লেগেছে এত যে ভাল চাঁদ বুঝি তা জানে।' ভীষণ উৎসাহী হয়ে রবীন বললেন, পরের লাইন লিখুন...। লিখলাম রাতের বাসরে দোসর হয়ে/ তাই সে আমায় টানে"। এভাবেই সেদিন যে গানটি রচিত হয় এবং সঙ্গীত-জগতে গানটিকে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই গান বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় গেয়েছেন কেউ? তখন তিনি বলেন, হ্যাঁ হিন্দি ভাষায়। এই ছাড়াও আমার অনেক গান হিন্দি, উর্দুসহ কয়েকটি ভাষায় ভাষান্তর হয়েছে। আমার জনপ্রিয় গানগুলো গেয়েছেন- উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদসহ দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা। কিন্তু তালাত মাহমুদ আর আমাকে বলা হতো 'যুগলবন্দি'।

বর্তমান গানের অবস্থা জানতে চাইলে কে জি মোস্তফা বলেন, আধুনিক ব্র্যান্ড সঙ্গীত শোনে মনে হয়, তাৎক্ষনিক উত্তেজনা, চিৎকার, উল্লাস ছাড়া আর কিছুই না। এরা তথাকথিত আধুনিকাতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তারা বুঝতে পারছে না এখন কোথায় আছে? অথচ এদের গলায় যথেষ্ট লাবণ্য আছে কিন্তু মূল বিষয়টা ধরত পারছে না। উঠাতে পারছে না প্রকৃত স্বত্তাকে। তবে কয়েকজন ব্যতীত, অন্যেরা অনুকরণে ব্যস্ত। বাংলা গানের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- মেলোডি; তা না হলে বোধের জগত কে টানে না। গান গান হয়ে উঠে না। এই অবস্থার জন্য দায়ী গীতিকার ও সুরকাররা। তবে প্রজন্মকে বিষয়টা বুঝে হাটঁতে হবে। 

Comments

The Daily Star  | English

Türk concerned over changes in Bangladesh's legislation banning activities of parties

"This [the changes in legislation] unduly restricts the freedoms of association, expression, and assembly," says the UN high commissioner for human rights

1h ago