মায়া সভ্যতার রহস্যময় সত্তা অ্যালুশ
ভালো ফসল দেবে তারা। করবে সমস্ত জমিজমার তত্ত্বাবধান। দায়িত্ব নেবে একেবারে ৭ বছরের জন্য। এর ভেতর জমির সবরকম দেখভাল করবে খর্বাকৃতির এই সত্তা। তবে ৭ বছর পেরিয়ে গেলে সিলগালা করে দিতে হবে তাদের জন্য নির্মিত ঘর। তা না হলে একেবারে দুর্দমনীয় দানব হয়ে উঠবে তারা। এমন এক অদ্ভুত রহস্যময় খর্বাকৃতির সত্তাদেরই বলা হতো 'অ্যালুশ।'
বাস্তবে অ্যালুশদের দেখা যায় না। তারা অন্ধকারে থাকা রহস্যময় সত্তা। ইউকাতান পেনিসেলভেনিয়ায় ছিলো এদের অস্তিত্ব। মেক্সিকোর চিচেন ইতজার ধ্বংসাবশেষেও পাওয়া গেছে এদের প্রতিমূর্তি।
অ্যালুশ
প্রাচীন মায়া সভ্যতায় মানুষের বিশ্বাস ছিলো নানান রকম অলৌকিক ও আধিভৌতিক ব্যাপারে। বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা আরাধনা করতেন বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির। এমনই এক শক্তিধর সত্তা ছিলো 'অ্যালুশ।' এদের ''অ্যালুশু'ব' ও বলা হতো। এরা ছিলো লম্বায় মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার থেকে সর্বোচ্চ ৩ ফুট পর্যন্ত। মাটি দিয়ে এদের মূর্তি গড়া হতো। বিভিন্ন দেয়ালচিত্রেও দেখা যেত এদের। অ্যালুশুদের মূল কাজ ছিলো চাষীদের ফসলের ৭ বছরের জন্য নিরাপত্তা দেওয়া।
অ্যালুশদের আবাস স্থল
প্রাচীন মায়া সভ্যতার মানুষ বিশ্বাস করতেন ৩ সমতলের ধারণায়। আকাশ, মাটি আর শিবালবা। এই 'শিবালবা' ব্যাপারটা হলো আন্ডারওয়ার্ল্ড বা মাটির নিচের এমন এক জগৎ, যেখানে স্বাভাবিকভাবে মানুষেরা যেতে পারেন না। এই 'অ্যালুশরা' সেখানে থাকে। কারও ওপর রুষ্ট হলে তাকে নিয়ে চলে যায় সেই অভেদ্য রহস্যময় জগতে।
এ ছাড়া যখন কোনো কৃষকের ফসল সুরক্ষার দরকার হয়, তখন জমিতে ছোট করে বাড়ি বানিয়ে রাখতে হতো এদের জন্য। কৃষকেরা চাইলে এদের স্থাপন করতে পারতেন জমির সবচেয়ে পুরনো গাছের গোড়ায়।
এদের অনেকে মনে করতেন 'মায়া সভ্যতার গবলিন।' আবার পলটারজিস্ট বা গোলেমের মতো আধিভৌতিক সত্তাগুলোর সঙ্গেও মিল পাওয়া যায় এদের।
অ্যালুশের প্রাণপ্রতিষ্ঠা
যখন কেউ নতুন জমি কিনতেন, কিংবা জমিতে প্রথমবারের মতো কোনোকিছু চাষ করতে যেতেন, তখন দরকার হতো 'অ্যালুশ'-এর সাহায্যের। পুরোহিতদের ধারণা ছিলো এদের তুষ্ট না করলে বা নৈবেদ্য না দিলে পুরো জমি জুড়ে এদের অভিশাপ নেমে আসবে। ফলে ফসল ধ্বংস হবে, ঘটবে মহামারি, ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘরে ঘরে হবে রোগের বিস্তার। তাই পুরোহিতরা বিভিন্ন মন্ত্রের সাহায্যে 'প্রাণপ্রতিষ্ঠা' করতেন এদের ভেতর। পুরোহিতদের বলা হতো শ্যামোন।
এজন্য লাগতো জমির সবচেয়ে উর্বর অংশের মাটি। আর লাগতো জমির মালিকের শরীর থেকে নেওয়া অল্প রক্ত। মাটিতে সেই রক্ত মিশিয়ে তারপর দেওয়া হতো অ্যালুশের আকৃতি। এরপর সুনির্দিষ্ট কিছু গোপনীয় মন্ত্রের মাধ্যমে করা হতো প্রাণপ্রতিষ্ঠা।
অ্যালুশ: রক্ষক নাকি দানব
অ্যালুশ নামের এই রহস্যময় সত্তা জমিজমার ফসলকে রক্ষা করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন কৃষকেরা। তবে সেই রক্ষণাবেক্ষণের মেয়াদ থাকতো ৭ বছর। এরপর আর একদিন অতিক্রান্ত হলেই এই রক্ষকরা প্রকাশিত হতেন দানবের ভূমিকায়। তারপর থেকে জমিকে তারা মনে করতেন নিজস্ব সম্পত্তি। জমির মালিকের ওপর নেমে আসত বিপদের ঘনঘটা। এলাকায় মানুষ অসুস্থ হতে শুরু করতো, প্রচণ্ড ঝড়ে ফসল নষ্ট হয়ে যেত, জমির সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও ঘটত দুর্ঘটনা।
তবে এসবকিছুই আবার হতো সূর্যাস্তের পর। যেহেতু, এরা অন্ধকারের বাসিন্দা, 'শিবালবা' নামের রহস্যময় স্তরে এদের বাস; তাই সূর্যাস্তের পরই সাধারণত আক্রমণ হতো।
তাই এমন নিয়ম ছিলো যে, প্রতিষ্ঠার ঠিক সপ্তম বার্ষিকীতে এদের জন্য তৈরি ঘর সিলগালা করে দিতে হবে। সেটা করতে হবে সূর্যাস্তের আগেই। তাহলে আর কোনো কুপ্রভাব দেখা যাবে না।
এমন দানবীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে আবার অনেকে মনে করতেন এই সত্তার সম্পর্ক শয়তানের সঙ্গে। বিশেষত মূর্তি গড়তে জমির মালিকের রক্ত প্রয়োজন হওয়ায় একে 'শয়তানের দোসর' বলতেন অনেকেই।
অ্যালুশের অস্তিত্ব
১৯৯৩ সালের কথা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনথ্রোপোলজি অ্যান্ড হিস্ট্রির কয়েকজন গবেষক মেক্সিকো যান গবেষণার কাজে। সেখানে চিচেন ইতজার কাছের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অংশে কিছুতেই খনন বা অন্য কোনো কাজ করতে পারছিলেন না তারা। সেখানে ছিলো ছোট একটি ঘর, 'কাহতাল অ্যালুশ' বা অ্যালুশের আবাস। সিলগালা সেই ঘরের ভেতরে ছিলো কয়েক হাজার বছরের পুরনো এক মূর্তি।
স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা ছিলো, তখন সেটি হয়তো ঠিক ৭ বছরের মধ্যে সিলগালা করা হয়নি। গবেষকদের কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকলেও স্থানীয়রা একজন শ্যামোন বা পুরোহিত ডেকে আনেন। এরপর সমস্যাটির সমাধান হয়। যদিও গবেষকরা সত্যিকার অর্থে এর অস্তিত্ব আছে বলে মানতে চাননি।
তবে এখনো সেখানকার আদিম আধিবাসীদের ভেতর গোপনে এর চর্চা রয়েছে। যদিও তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীয়মান।
Comments