বাজেটে ভর্তুকি বাড়ছে ১৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা

budget 2022-23

আগামী অর্থবছরের বাজেটে আসছে রেকর্ড পরিমাণ ভর্তুকি। তবে, এমন একটি অদ্ভুত সময়ে আমরা আছি যখন সরকারের এই রেকর্ড ভর্তুকি বরাদ্দও প্রয়োজনের তুলনায় কম হতে পারে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণে বিশ্ব বাজারে পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম সাধারণ মানুষের জন্য, বিশেষ করে দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় এবং মহামারি পরবর্তী পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়া রোধ করতে সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার ভর্তুকি প্যাকেজ প্রস্তুত করেছে। যা আগের অর্থ বছরের ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার ভর্তুকির চেয়ে ২১ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে গত মার্চে তেলের দাম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এবং সার ও প্রাকৃতিক গ্যাস রেকর্ড দামে পৌঁছেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, 'দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এমনিতেই কমে গেছে। এ বছরটাকে ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখতে হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি খুব বেশি দিন চলবে না।'

এই কারণেই তেল, সার, গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।

আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা এই খাতে আগামী অর্থবছরের মূল বাজেটের দ্বিগুণ এবং সংশোধিত বাজেট থেকে ৫০ শতাংশ বেশি।

সারেও পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এই খাতে ভর্তুকি দিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে এর পরিমাণ ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল আমদানিতে র পাশাপাশি সরকারের সুদের বাধ্যবাধকতা এবং বেতনের জন্য ভর্তুকি বিবিধ ওভারহেডের আওতায় পড়ে, যার অংশ এই বছরের মূল বাজেট থেকে প্রায় ৬৮ শতাংশ বেড়ে ১৭,৩০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে।

এত ভর্তুকির পরেও তা মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে যথেষ্ট নাও হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেইন মনে করেন, তেল, সার, গ্যাস ও বিদ্যুতের উচ্চমূল্য এবং মূল্যস্ফীতির প্রভাব পুরোপুরি কমানোর জন্য ভর্তুকি বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।

তিনি বলেন, 'এর অর্থ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামের ক্ষেত্রে কিছু সমন্বয় হবে এবং বিপিডিবি (বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) ও বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) দাম বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।'

তেল, গ্যাস ও সারের দাম সহজে কমবে না, তবে এরগুলোর দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি নেই বলে মনে করেন তিনি।

জাহিদ হুসেইন আরও বলেন, 'বিদ্যমান অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে সরকার দাম কমিয়ে রাখতে পারবে না। তখন মূল্য সমন্বয় করতেই হবে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ থাকবে।'

তিনি জানান, সরকার রপ্তানি ভর্তুকি ও রেমিট্যান্সের জন্য ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রত্যাহার করে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেগুলো পুনর্বিন্যাস করে এই পরিস্থিতি এড়াতে পারত।

এই ২ খাতে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা মূল বাজেটের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।

জাহিদ হুসেইন বলেন, 'রেমিট্যান্সের জন্য নগদ ভর্তুকির কোনো প্রয়োজন নেই।'

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ডলারের অফিসিয়াল বিনিময় হার ও হুন্ডি বাজারের হারের মধ্যে প্রায় ৫ টাকার পার্থক্য হয়ে গেছে। যা অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের জন্য যে পরিমাণ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে তারচেয়েও বেশি।

তিনি বলেন, 'টাকার অনেক অবমূল্যায়ন হয়েছে। কাজেই বিনিময় হারটাও নমনীয় হতে দিন।'

জাহিদ হুসেইনের মতে, এতে করে সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়বে এবং আমদানিতে লাগাম টানা যাবে। রপ্তানিকারকরাও এতে করে উপকৃত হবেন, কারণ তারা তাদের ডলারের চালানের বিপরীতে বেশি পরিমাণে টাকা পাবেন।

তিনি বলেন, 'রপ্তানিতেও ভর্তুকির প্রয়োজন নেই। রপ্তানি ভর্তুকির পুরো বিষয়টি ছিল পণ্য ও দেশীয় বৈচিত্র্যকে উত্সাহিত করা। কিন্তু তা একেবারেই হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে ভর্তুকি নীতি কার্যকর হয়নি। প্রশ্ন ওঠে, কেন আমরা সমস্যার মূলে পৌঁছাতে পারছি না?'

এই ভর্তুকির অর্থ নগদ সহায়তা হিসেবে সমাজের সেই সব মানুষের কাছে যাওয়া প্রয়োজন যাদের পক্ষে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'ভর্তুকি থেকে সবাই লাভবান হয়, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না। ধনীরা মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা সহজেই সামলে নিতে পারলেও দরিদ্র বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলরা তা পারেন না।'

কৃত্রিমভাবে দাম কমানোর জন্য ভর্তুকি দেওয়ার পরিবর্তে সরকারকে দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের জন্য আয় সহায়তার জন্য ব্যয় করার সুপারিশ করেন এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, 'এই নগদ অর্থ অবশ্যই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। সরকারের সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে কার্যকর চ্যানেল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। খোলা বাজার বিক্রি এবং স্বল্পমূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ কর্মসূচিতে অনেক অনিয়ম রয়েছে। যাদের এটা দরকার তারা সব সময় পায় না।'

এই খাতে প্রায় ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা মূল বাজেটের চেয়ে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

5h ago