পি কে হালদার কেন কানাডায় অবস্থানকে নিরাপদ মনে করেননি?

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বৃহত্তম কেলেঙ্কারির প্রধান হোতা প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) কয়েকজন সহযোগীসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এই অভিযান পরিচালনা করে। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারের একদিন পর আজ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে ইডি ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বৃহত্তম কেলেঙ্কারির প্রধান হোতা প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) কয়েকজন সহযোগীসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এই অভিযান পরিচালনা করে। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

বাংলাদেশে খুব ভালো বা উন্নত জীবনযাপন করতে একজন মানুষের বা একটা পরিবারের কত টাকা লাগে? ২-৩-৫-১০ লাখ? পি কে হালদার তার যোগ্যতা অনুযায়ী সে পর্যায়েরই চাকরি করতেন। সেই পরিমাণ অর্থ তিনি উপার্জন করতেন বা তার বেশিই করতেন। কিন্তু তাতেও হয়নি, তিনি আরও চেয়েছেন। সেটা তিনি চাইতেই পারেন, সে চাওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু সেটা তিনি অর্জন করতে চেয়েছেন দেশকে, দেশের মানুষকে ঠকিয়ে, তাদের হক মেরে। সেটা করতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্রের অনেকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পথে বসিয়েছেন। নিজে দৌলতের বাদশা সেজেছেন।

কিন্তু এই দৌলত তাকে নিরাপত্তা ও সুখ দিতে পারেনি। এই দৌলতে তিনি দৌড়ের ওপর থেকেছেন। বাংলাদেশ, দুবাই, কানাডা, ভারত দৌড়ে বেড়িয়েছেন। কোথায় গেলে নিরাপদ আশ্রয় পাবেন সেই খোঁজ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো দেশই তার নিরাপদ আশ্রয় হয়নি।

জানা যায়, পি কে হালদারের বাবা মৃত প্রণবেন্দু হালদার পেশায় ছিলেন দর্জি। মা লীলাবতী হালদার ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। গ্রামের অতি সাধারণ ঘরের সন্তান কিভাবে এতটা বেপরোয়া হলেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন? ব্যক্তি হিসেবে তিনিই এ জন্য অবশ্যই দায়ী। আমাদের সমাজ, সরকার, প্রশাসনও এ দায় থেকে মুক্ত নয়। এর সঙ্গে জড়িত বলে বড় বড় রাঘব বোয়ালদের নাম শোনা যায়। যে কারণে ব্যক্তির অপরাধের বিচার ও শাস্তি যেমন অনিবার্য, একইসঙ্গে যে কাঠামো ও ব্যবস্থায় এত বড় দুর্নীতি করতে পারা যায়, সেখানেও হাত দেওয়া দরকার। সেগুলোরও সংস্কার ও মেরামত প্রয়োজন।

পি কে হালদার কোথাও স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করেননি। যে কারণে নিজের নাম, পরিচয়, দেশ, পেশার পরিবর্তন করেছেন। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের এই সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভারতে শিবশঙ্কর হালদার নামে সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। এই নামে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রেশন কার্ড, ভোটার আইডি করেছেন। ব্যাংকার থেকে মাছ ব্যবসায়ী সেজেছেন। চোরাই অর্থে সব পরিবর্তন করেছেন। পরিচয় জালিয়াতি করে বহাল তবিয়তে ছিলেন।

পি কে কোথায় লুকিয়ে আছেন? এ নিয়ে পত্রিকায় অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বার বার কানাডার নামই উঠে এসেছে এবং বলা হয়েছে যে তিনি সেখানেই আত্মগোপন করে আছেন। বলা হয়েছে, কানাডাই বাংলাদেশের অভিযুক্ত অর্থপাচারকারী ও দুর্নীতিবাজদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

কিন্তু পি কে হালদারের গ্রেপ্তার সে তথ্য মিথ্যে প্রমাণ হলো। এখানেও তিনি মিডিয়ার চোখে ধূলা দিয়েছে, সবাইকে বোকা বানিয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন ও খটকা থেকেই গেল। দেশ-বিদেশের এত সব মিডিয়া এ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দিতে পারলো না, তা কি করে হয়? তারা শুধু বার বার কানাডার দিকেই আঙ্গুল তুলে গেল।

এগুলো করেও তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি। অবশেষে ধরা পড়লেন। চোরের মত মাথা নিচু করে লজ্জায়, অপমানে কাঁচুমাচু হয়ে পুলিশের সামনে দাড়িয়ে আছেন, চোখের জল ফেলছেন। মাথা উঁচু করে থাকা সরকারি পদ-পদবি, সম্মান পায়ে ঠেলে অতিলোভে আজ কলঙ্কের ও কয়েদির জীবনযাপন করছেন।

আমরা কানাডায় লুটেরা বিরোধী মঞ্চের পক্ষ থেকে সবসময় বলেছি, কানাডাকে কোনোভাবেই বাংলাদেশের লুটেরা, অর্থপাচারকারী ও দুর্নীতিবাজদের নিরাপদ আশ্রয় হতে দেওয়া যাবে না। তার জন্য আমরা বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেছি। আমরা আমাদের সেই বক্তব্য নিয়ে সোচ্চার ছিলাম, এখনো আছি। কানাডায় বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও তাকে নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল। যে কারণে তার এখানে বসবাস ও কিছু করা কোনোভাবেই সহজ হতো না। সেই কারণে পি কে হালদার কানাডাকে তার জন্য নিরাপদ আশ্রয় মনে করেননি। সেটা হয়নি বলেই তাকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

পি কে যেভাবে নিজের নাম, পরিচয়, পেশা পরিবর্তন করে নতুন বেশ ধরেছেন, সেটা ভারতেই সম্ভব ছিল, কানাডায় কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এখানে থাকলে তাকে তার পরিচয়েই থাকতে হতো। আর সেটা থাকতে গেলে তাকে ধরা পরতেই হতো। কারণ তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ইন্টারপোলে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা ছিল। উপরন্তু পত্রিকাগুলোতেও তার বিরুদ্ধে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছিল।

সংবাদ মাধ্যম বলছে, পি কে হালদার ও তার সহযোগী সুকুমার মৃধার বিপুল সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তারা কয়েকটি অভিজাত বাড়িসহ বিপুল সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। বাড়িগুলো থেকে জমির দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথি উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু কানাডায় তাৎক্ষনিক এই বিপুল অর্থের বিনিয়োগের কাজটি তার জন্য সহজ হতো না।

গত বছর বাংলাদেশ থেকে একজন প্রভাবশালী সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, পি কে হালদার কানাডার কোথায় থাকেন? তার অবস্থান কি? একটি রিপোর্ট করতে চাই। তখন এক প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, তিনি তাকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে টরন্টোর ইটোবিকোতে তার ভাইপোর এক বিশাল জন্মদিনের পার্টিতে দেখেছিলেন। তখন শুনেছিলাম, তার ভাইয়ের নামে এখানে ব্যবসা, বাড়ি ও সম্পদ আছে, তার অংশীদারও নাকি তিনি। তবে, কী পরিমাণ সম্পদ আছে তা জানা যায়নি। ২০১৮ সালের পরে তিনি আর কানাডায় ঢুকেছেন কি না বা ঢুকতে পেরেছিলেন কি না সেটা জানা যায়নি। এর বেশি কিছু জানাতে পারিনি।

তারপরও অনেক সংবাদ চোখে পড়েছে যে, পি কে হালদার কানাডায় অবস্থান করছেন, এখানেই আত্মগোপন করে আছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন ইত্যাদি। তারা বলতে চেয়েছেন, কানাডাই একমাত্র দেশ যেখানে এসব বড় অভিযুক্ত অপরাধী, দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারীরা আশ্রয় পায়। কিন্তু তার গ্রেপ্তারে প্রকৃত সত্যটা বেরিয়ে এলো। আমরা বারবার বলেছি, শুধু কানাডা নয় আরও অনেক দেশ আছে, যারা এ সব লুটেরাদের আশ্রয় দেয়।

পি কে কানাডায় এসেছিলেন, চেষ্টা করেছেন এখানে থাকতে, কিন্তু পারেননি। কেননা, কানাডাকে তিনি দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ স্থান মনে করেননি। অর্থপাচারকারী ও দুর্নীতিবাজ অপরাধীরা নানা পরিচয়ে, বর্ণচোরা হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছেন। সরকার সেসব দেশের সঙ্গে কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে তাদের ধরতে পারে, পাকরাও করতে পারে—পি কে তার প্রমাণ। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তার গ্রেপ্তারের বিষয়ে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কিছু জানায়নি। এ ব্যাপারে ভারত জানালেই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তার গ্রেপ্তারে অনেক কিছু হয়ে গেছে, এখনই তেমন কথা বলার সময় নয়। তবে যতটুকু হয়েছে সেটুকুই বা কম কী? এটা অন্যদের জন্য সতর্ক বার্তা। আমাদের দায়িত্ব এ সব লুটেরাদের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে আলাপ ও সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। একদিন বাকিরাও জালে আটকা পড়বে, তাদের হাতেও হাতকড়া পড়বে।

ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক, এক্টিভিস্ট ও সংগঠক, লুটেরা বিরোধী মঞ্চ, কানাডা

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Has the war in Gaza exposed limitations of free speech in US?

Protests have rocked US university campuses over the last week as pro-Palestinian students have encamped on the grounds of Columbia, Yale, and New York University, among other prestigious educational institutions, urging universities to divest from the state of Israel amid the ongoing genocide.

42m ago