হাঁটার অযোগ্য শহর ঢাকা
আপনি সকাল ১০টার ক্লাস ধরার জন্য ৮টায় বের হলেন, শুধুমাত্র উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য দুটি ক্লাসে যোগ দিলেন এবং দুপুরে খাবারের সময় আবার যখন বাসার পথে রওনা হলেন, ততক্ষণে পুরো শহর থমকে গেছে। আমার ধারণা, রাজধানীর বেশিরভাগ মানুষই এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলেন, পুরো ১৫ মিনিট ধরে বাসটি এক ইঞ্চিও নড়েনি। আপনি বাস থেকে নেমে রোদ মাথায় নিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরতে উদ্যত হলেন, কিন্তু হাঁটার জন্যও পথে এক চিলতে জায়গা নেই।
ফুটপাত বলে যদিও বা কিছু থেকে থাকে, সেটি হয় দোকানি অথবা ফেলে রাখা নির্মাণসামগ্রীর দখলে। দুইপাশে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বাস রেখে, রাস্তার একেবারে মাঝখানে আরও ৫ জন মানুষের পেছনে দাঁড়িয়ে যখন দেখলেন এক ব্যক্তি খালি রিকশাগুলো টপকিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আপনি অনুধাবন করবেন, আপনার মতো পথচারীরা নগর পরিকল্পনায় সবচেয়ে কম প্রাধান্য পেয়েছেন।
কী প্রক্রিয়ায় মানুষ শহরের মধ্যে যাতায়াত করে, সেটা দিয়ে সে শহরের জীবনযাত্রার গুণগত মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যান্ত্রিক পরিবহনের আগ্রাসনের এই যুগে, যেখানে হাঁটাহাঁটির সুযোগ রয়েছে, সেখানটাকেই প্রকৃতপক্ষে বসবাসযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
একটি হাঁটার উপযোগী শহরের নগর পরিকল্পনায় পথচারীদেরকে যন্ত্রচালিত যানবাহনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইফতেখার রহমান ইফতি বলেন, 'আমি রাতে ছাত্র পড়ানোর পর প্রায়ই হেঁটে বাসায় ফিরি। ভাঙা ফুটপাথ ও সড়ক বাতি না থাকায় পুরো অভিজ্ঞতাটি সমস্যাপূর্ণ ও ভীতিকর।'
'ব্যাপারটা অবর্ণনীয় কষ্টের হয়, যখন আপনি খোলা ম্যানহোল ও নর্দমার মুখোমুখি হবেন। আমি এক রাতে মগবাজারের কাছাকাছি জায়গায় এরকম এক ম্যানহোলে পড়ে গিয়েছিলাম। সৌভাগ্যজনকভাবে, আমি ম্যানহোলের এক প্রান্ত আঁকড়ে ধরতে সক্ষম হই এবং কোনোমতে ভেতরে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি। তারপর থেকে আমি ওই এলাকার ফুটপাথগুলো এড়িয়ে মূল সড়ক ধরে হাঁটি', যোগ করেন তিনি।
একটি শহর হাঁটার জন্য কতটুকু উপযুক্ত, তা নির্ভর করে সেখানে কতটুকু জায়গার ওপর ফুটপাত নির্মিত হয়েছে এবং তার গুণগত মান কেমন, সে বিষয়গুলোর ওপর। ঢাকায় ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার ফুটপাতের প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এর মধ্যেও, বেশিরভাগ ফুটপাত এবড়োথেবড়ো, ভাঙাচোরা অথবা খোলা নর্দমা ও ম্যানহোলে ভর্তি।
আপনি যদি ফুটপাতের একটি খালি অংশ কোনোমতে খুঁজেও পান, খুব সম্ভবত সেটি নির্মাণকাজের বর্জ্য, ময়লা, রাস্তার পাশের ফেরিওয়ালা বা স্টলের দখলে রয়েছে। ফুটপাতে হাঁটার জায়গা না পেয়ে ইফতির মতো অনেক পথচারী মূল সড়ক দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হন। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে।
জলাবদ্ধতার কারণেও ঢাকা শহরে হাঁটা দুষ্কর হয়ে পড়ে। পয়ঃনিষ্কাশনের নর্দমাগুলো প্রায়ই খোলা ও এলোমেলো অবস্থায় থাকে।
হলিক্রস কলেজের শিক্ষার্থী নুজায়মা ইসলাম অরুনিমা বলেন, 'বর্ষা মৌসুমে আমাদের বাসার পাশের রাস্তা খুবই বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় আপনার পায়ের নিচে কী আছে, তা আপনি দেখতে পাবেন না। কোনটি একটি ছোট গর্ত আর কোনটি খোলা ম্যানহোল, সেটা আপনি বুঝতেই পারবেন না।'
'নর্দমা থেকে আসা পানি, রাস্তার পাশে ফেলে রাখা আবর্জনা ও বৃষ্টির পানিতে রাস্তা আটকে যায়। আমি কিসে পা দিতে যাচ্ছি, তা আমি নিজেই বুঝতে পারি না', যোগ করেন তিনি।
মিরপুর, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী ও দক্ষিণ ঢাকার বেশিরভাগ জায়গায় জলাবদ্ধতার কারণে কোথাও হেঁটে গেলে তা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় পরিণত হয় এবং প্রতি পদে পদে বিপদের আশঙ্কা থাকে।
প্রতিটি রাস্তার মোড় এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে সেখান দিয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ যানবাহন যেতে পারে এবং উচ্চ গতিতে মোড় ঘুরতে পারে। এভাবে ট্রাফিক জট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ায় সেটি সামগ্রিকভাবে ক্রসিংয়ের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেয়। ফলে পথচারীদের জন্য জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ব্যস্ত সড়কে ফুট-ওভার সেতু নেই এবং যেগুলো আছে, সেগুলোও অপরিষ্কার। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো তেমন একটা নিরাপদও থাকে না এবং গৃহহীনরা সুযোগ পেলেই সেখানে আস্তানা গেড়ে বসে থাকে।
নিরাপত্তার খাতিরে ইফতি কখনোই ফুটওভার সেতু ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। বিশেষত, রাতে বাসায় ফেরার পথে।
'আমি দেরি করে বাসায় ফিরি এবং সব সময় ওভারব্রিজ এড়িয়ে যাই। কারণ এসব জায়গাগুলোতে ছিনতাইকারী, পকেটমার ও আরও বিভিন্ন ধরনের দুষ্কৃতিকারীরা ওঁত পেতে বসে থাকে', বলেন ইফতি।
পথচারীদের সারাক্ষণই এরকম নানা বিপদ পাড়ি দিয়ে চলতে হয়, যার ফলে হতাহতের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সড়কে প্রাণ হারানো মানুষের ৪৩ শতাংশই পথচারী।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, অন্য যেকোনো বিষয়ের মতো, এ ক্ষেত্রেও নারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি খারাপ। নীলক্ষেতের জনবহুল ফুটপাতই হোক, কিংবা রাতের জনশূন্য ফুটপাতই হোক না কেন, ঢাকার রাস্তায় নারীদের জন্য নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। পুরুষদের তির্যক দৃষ্টি, ব্যস্ত রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ভয় অথবা প্রতিদিনের সংবাদপত্রে আসা আরও ভয়াবহ কোনো খবরের বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়ার ভয় তাদেরকে তাড়া করে ফেরে। নারী পথচারীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ঢাকার অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজোয়ানা সায়মা বলেন, 'আমার মনে একটি ভয় আছে, যা আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। সেটি হলো, ব্যস্ত সড়কে অচেনা মানুষরা আমাকে বিরক্ত করবে অথবা কোনো অজুহাতে আমাকে স্পর্শ করবে। এই চিন্তাটি সারাক্ষণ আমার মাথায় কাজ করতে থাকে। সাধারণত, আমি একটি রিকশা বা বাসে উঠে যাই, কিন্তু এগুলোও যে খুব নিরাপদ কোনো বিকল্প, তা নয়। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম আমাকে বাধ্য করেছে সময়মতো কোনো জায়গায় পৌঁছানোর জন্য পায়ে হাঁটার দ্বারস্থ হতে। মনে থাকা সার্বক্ষণিক ভয়ের কারণে আমার জন্য বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেছে।'
'আমার মহল্লার আশেপাশে সন্ধ্যার পর হাঁটতে বের হওয়ার কথা তো বাদই দিলাম, জরুরি ওষুধ বা মুদি দোকানের পণ্য কেনার জন্য বের হতে গেলেও আমাকে দুইবার ভাবতে হয়। ওষুধ কেনার মতো সহজ একটি কাজের জন্য কেন আমাকে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে?', যোগ করেন সায়মা।
একটি শহরকে পথচারী-বান্ধব করতে হলে কিছু প্রাথমিক সুবিধা দিতে হয়। গণ শৌচাগার, নিয়মিত বিরতিতে বসার বেঞ্চের ব্যবস্থা, ময়লা ফেলার জায়গা, উপযুক্ত পরিমাণ গাছ গাছালি—এসবই পথচারী-বান্ধব পরিবেশ তৈরির মৌলিক চাহিদা।
একটি পথচারী-বান্ধব শহরে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ জায়গায় গাছগাছালি থাকার কথা। কিন্তু ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার মাত্র ৫ শতাংশ জায়গায় সেটি রয়েছে। সড়কে যথেষ্ট পরিমাণ আলোর উৎসের অভাব, সুপেয় পানির সরবরাহ না থাকা অথবা প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ নকশায় নির্মিত ফুটপাত না থাকা—একটি জিনিসকেই প্রমাণ করে, তা হলো ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে যানবাহন চলাচলকে মাথায় রেখে। অথচ, এ শহরের মোট যাতায়াতের ১৯ দশমিক ৬ শতাংশই হয় পায়ে হেঁটে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় এই হার বিস্ময়করভাবে বেড়ে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ হয়।
একটি নিশ্চুপ শনিবারে, মিন্টো রোডে হঠাৎ ৫ মিনিটের জন্য যখন আমি আবিষ্কার করি, কোনো গাড়ি জোরে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে না বা আমার মাথায় রাস্তা পার হওয়ার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা কাজ করছে না, তখন পথচারী হিসেবে সামান্য গর্ববোধ করি। আমার মতো আরও অসংখ্য মানুষের কাছে হাঁটা শুধু একটি বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা নয়। এটি আমাকে ঢাকা নামের জগাখিচুড়িকে আরও কাছে থেকে দেখতে ও অনুভব করতে সাহায্য করে।
এই শহুরে জঙ্গলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে বলি, এই গোলযোগ আর কুয়াশাচ্ছন্ন ধুলা এসে শহরকে দখল করে নেওয়ার আগে থেকেই এখানে আছি আমি। এই শহর আমার।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments