নীতি পুলিশিং ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ জরুরি

পুরাণ কথায় 'তিলোত্তমা' বলে একটা শব্দ আছে। দেবতাকূলে ভয়ংকর রাক্ষস সুন্দ ও উপসুন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে তাদের বিনাশের জন্য ব্রহ্মার নির্দেশে তিল তিল করে সৌন্দর্য সঞ্চয় করে একটি নারী সৃষ্টি করা হয়েছিল। যার নাম 'তিলোত্তমা', যিনি নিখুঁত, পরমাসুন্দরী, অত্যন্ত আকর্ষণীয়। স্বৈরাচার এরশাদ তার কবিতায় রাজধানী ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। এছাড়া অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী বা আবেগী নাগরিকও ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী বলে থাকেন।

কিন্তু আবেগের বিপরীতে বাস্তবতা বড়ই নির্মম, অনেকটা পূতিগন্ধময়, নোংরা। নানা সূচকে এই শহরের কিছু কিছু এলাকা অনেক আগেই অনিরাপদ ও বসবাস অযোগ্য বলে দেশি-বিদেশি সনদ পেয়েছে। তারপরও মানুষ জীবিকার তাগিদে, উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষায় এই শহরে বাস করেন। এই শহরকে আপন করে নেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই রাজধানী ঢাকায় নীতি পুলিশিংয়ের যে চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে দেখা দিয়েছে নতুন আতঙ্ক। বাড়ছে নাগরিকের নিরপত্তাহীনতা। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এমন দিন দেখার জন্যেই কি কয়েক মাস আগে ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমেছিলেন এই শহরের মা-বোন-কিশোরীরা।

আইনশাস্ত্রে নীতি পুলিশিং বলতে একজন ব্যক্তির একান্ত বিবেচনা অনুযায়ী অনৈতিক ও আইন-বিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়াকে বোঝায়। জনপরিসরে এই কাজ একজন নাগরিক বা সরকারের কোনো বাহিনী বা প্রতিষ্ঠান করে থাকতে পারে। সাধারণত রক্ষণশীল সমাজে এই নেতিবাচক চর্চা বেশি দেখা যায়। ২০২২ সালে ইরানে পোশাকবিধি অমান্য নিয়ে নীতি পুলিশিংর এক ঘটনায় প্রাণ হারানো কুর্দি তরুণী মাশা আমিনীর মৃত্যু সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। নীতি পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন লাখো নাগরিক।

ধূমপান অবশ্যই একটি বদঅভ্যাস, ক্যানসারসহ নানা রোগের কারণ। অনেকেই বলে থাকেন মাদকাসক্তির প্রথম ধাপ ধূমপান। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সারাবিশ্বের কোথাও ধূমপান নিষিদ্ধ নয়। বাংলাদেশেও ধূমপান বৈধ। আর ধূমপান শুধু পুরুষ জাতির একান্ত অধিকার, সেটিও কোনো আইন-কানুন বা বিধিতে নেই। তাই প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো নারী তার নাগরিক অধিকারবলেই ধূমপান করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, ২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুসারে জনপরিসর ও গণপরিবহনে ধূমপানে সুনির্দিষ্ট কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইন অনুযায়ী পাবলিক প্লেস বলতে বুঝানো হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, বিমানবন্দর, প্রেক্ষাগৃহ ইত্যাদি। এছাড়া চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন জায়গাতেও ধূমপানে নিষেধাজ্ঞা আছে। কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে বাস, রেলগাড়ি, ট্রাম, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ধূমপানে। এই আইনে কোথাও রাস্তার ধারে, চায়ের দোকানে ধূমপানে নিষেধাজ্ঞা নেই।

কিন্তু রাজধানীর লালমাটিয়ায় গত শনিবার সন্ধ্যায় দুই তরুণীর ধূমপান ঘিরে এক ভীতিকর নীতি পুলিশিং চর্চা হয়ে গেল। যা পরে থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, চায়ের দোকানে ধূমপান করার জন্য ওই দুই নারীকে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করেন এক ব্যক্তি। খুব দ্রুতই সেখানে আরও মানুষ জড়ো হয়। পরে থানায় নিয়ে পরিবারের জিম্মায় ওই দুই নারীকে ছেড়ে দেয় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।

এই ঘটনায় নাগরিক অধিকার ও অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলায় নীতি পুলিশিং নিয়ে সমাজে বড় পরিসরে ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে। যা আরও পাকাপোক্ত করেছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বিপন্ন দুই নারীর পাশে না দাঁড়িয়ে সবক দিয়েছেন আইনি বিধির। যদিও ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। জনপরিসরের ব্যাপ্তি সম্পর্কেও তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ভাবতেই অবাক লাগে এমন অযোগ্য ও অসংবেদনশীল মানুষ রাষ্ট্রের এতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। যিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিপরীতে নীতি পুলিশিংকে উৎসাহ দিচ্ছেন।

ফিরে আসি কথিত 'তিলোত্তমা' এই নগরের নিত্যদিনের জীবনে। এই নগরীতে পায়ে হাঁটার পথ নেই, বাতাসে বিষ। গণপরিহবন শৃঙ্খলাহীন। শব্দদূষণে অন্যতম সেরা। যে শহরের মূল সড়ক দাপিয়ে বেড়ায় ব্যাটালিতচালিত রিকশা নামের নতুন যমদূত। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ট্রাফিক আইন মানেন না। পথের বাঁকে, ট্রাফিক সিগন্যালে টানা পার্টি ও ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য। এমন নগরে নতুন করে নীতি পুলিশিং এক ভীতিকর প্রবণতা। এটা এক ধরনের মারাত্মক ভাইরাস, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিপুল সংখ্যক নারীর কর্মজীবন বিপন্ন করতে পারে। বিশ্বে বাংলাদেশকে চিত্রিত করতে পারে রক্ষণশীল বলে। মনে রাখা প্রয়োজন সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের বিরোধী পক্ষ ঠিক এটাই চেয়ে আসছে। এটাই তাদের কয়মনবাক্যের কামনা।

নীতি পুলিশিং বন্ধ ও নাগরিকের নিরাপত্তার দায়-দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার। কিন্তু তার কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, তিনি অনেক আগেই আত্মসমপর্ণ করে বসে আছেন। তাহলে কি নিজেদের অধিকার রক্ষায় নারীদেরকেই রাস্তায় নামতে হবে?

শেষ কথা, ঢাকা কাল্পনিক জগতের তিলোত্তমা নগরীর রূপ লাভ করুক—এতটা প্রত্যাশা কারও নয়। কিন্তু এই নগরীতে ন্যূনতম আইনের শাসন থাক, নীতি পুলিশিং দেশের প্রচলিত আইন-কানুনকে ছাড়িয়ে না যাক, এই কামনা করা যেতেই পারে।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Comments

The Daily Star  | English

US opens door to tariffs on pharma, semiconductors

The trade war is raising fears of an economic downturn as the dollar tumbles and investors dump US government bonds, normally considered a safe haven investment.

32m ago