মানুষের সমতার বার্তা দেয় সিলেটের ৭ শ বছরের ‘লাকড়ি তোড়া উৎসব’

সিলেটে উদযাপিত হয়ে গেল সাত শ বছরের ঐতিহ্যবাহী লাকড়ি তোড়া উৎসব। আপাত ধর্মীয় মনে হওয়া এ‍ই উৎসবের পেছনে আছে মানুষে মানুষে সমতার বিষয়ে হজরত শাহ জালাল (রা.) এর জীবনের একটি শিক্ষণীয় ঘটনা।
লাকড়ি তুলতে লাক্কাতুরা চা বাগানের দিকে ছুটছেন সুফি সাধক হজরত শাহ জালাল (রা.) এর ভক্তরা। ছবি: শেখ নাসির

সিলেটে উদযাপিত হয়ে গেল সাত শ বছরের ঐতিহ্যবাহী লাকড়ি তোড়া উৎসব। আপাত ধর্মীয় মনে হওয়া এ‍ই উৎসবের পেছনে আছে মানুষে মানুষে সমতার বিষয়ে হজরত শাহ জালাল (রা.) এর জীবনের একটি শিক্ষণীয় ঘটনা।

আজ শনিবার ২৬ শাওয়াল যোহরের আজান শেষে হজরত শাহ জালাল (রা) মাজারের মোতাওয়াল্লীর অনুমতিতে মাজার প্রাঙ্গণে ঐতিহ্যের আলোকে বেজে উঠে ঢাক-ঢোল আর ব্যান্ডপার্টির ড্রামস।

সেই তালে তাল মিলিয়ে হাজারো মানুষ খালি পায়ে যাত্রা করেন প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সিলেটের শহরতলীর লাক্কাতুরা চা বাগান এলাকার একটি টিলার উদ্দেশে।

লাকড়ি তুলতে লাক্কাতুরা চা বাগানের দিকে ছুটছেন সুফি সাধক হজরত শাহ জালাল (রা.) এর ভক্তরা। ছবি: শেখ নাসির

সুফি সাধক হজরত শাহ জালাল (রা) এর ভক্তরা এ মিছিলে স্লোগান দেন 'লালে লাল, বাবা শাহ জালাল' কিংবা 'বাবা শাহ জালাল কি জয়, ৩৬০ আউলিয়া কি জয়' বলে।

আর ভক্তদের হাতে থাকে লালসালুতে জড়ানো দা ও কুড়াল জাতীয় হাতিয়ার যা দিয়ে কাটা হয় টিলায় থাকা গাছের ডালপালা।

৭০৩ বছর (মতান্তরে ৭৩৯) ধরে সিলেটের হজরত শাহ জালাল (রা.) এর ভক্তরা পালন করছেন এই ঐতিহ্যবাহী 'লাকড়ি তোড়া' উৎসব। লাকড়ি অর্থ কাঠ এবং তোড়া মানে কাটা বা ভাঙা। লাকড়ি তোড়া মানে কাঠ কাটা।

আজ লাকড়ি তোড়া উৎসবে অংশ নেন সর্বস্তরের কয়েক হাজার মানুষ। গত দুই বছর কোভিড-১৯ এর কারণে সংক্ষিপ্ত আয়োজনে শেষ হওয়ার পর এবার হাজারো মানুষের ঢল নামে এ উৎসবে।

লাকড়ি তুলতে ঢাক বাজিয়ে লাক্কাতুরা চা বাগানের দিকে ছুটছেন সুফি সাধক হজরত শাহ জালাল (রা.) এর ভক্তরা। ছবি: শেখ নাসির

হাজারো ভক্ত লাক্কাতুরার টিলায় পৌঁছানোর পর সেখানে অনুষ্ঠিত হয় মিলাদ শরীফ। সেখানে ভক্তদের মধ্যে তাবারক বিতরণ করা হয়।

এ সময় ভক্তরা টিলার গাছের ডালপালা কাটেন। গাছ কাটা নিষিদ্ধ থাকায় কোনো গাছ কাটা হয় না। লাক্কাতুরা ও মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিকরা গাছের ডাল আগে থেকে সংগ্রহ করে বিক্রি করেন।

পরে লাকড়ি নিয়ে আবারো মাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন ভক্তরা। মাজারে ফিরে এসব লাকড়ি বড় দিঘীতে তিন বার ডুবিয়ে পাশেই স্তূপ করে রাখেন। এই লাকড়ি আগামী ১৯-২০ জিলকদ, হজরত শাহ জালাল (রা) ওরশের শিরনি রান্নায় ব্যবহার করা হবে।

মাজারের মোতাওলাল্লী সরেকুম ফতেহ উল্লাহ আল আমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৬ শাওয়াল দিনটি হজরত শাহ জালাল (রা.) এর জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এদিন তিনি রাজা গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট বিজয় করেন। এর বেশ কয়েক বছর পর এদিনই তার মামা ও মুর্শিদ হজরত সৈয়দ আহমেদ কবীর ইন্তেকাল করেন।'

লাক্কাতুরা চা বাগান থেকে লাকড়ি হাতে নিয়ে ফিরছেন সুফি সাধক হজরত শাহ জালাল (রা.) এর ভক্তরা। ছবি: শেখ নাসির

'একবার এক কাঠুরিয়া হজরত শাহ জালাল (রা.) এর কাছে ফরিয়াদ নিয়ে আসেন যে তিনি কাঠুরিয়া বলে তার মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চাচ্ছে না। হজরত এর প্রতিকার সিলেট বিজয় দিবসে করবেন বলে জানান। সিলেট বিজয় দিবস উদযাপনের দিন হজরত তার সঙ্গী অনুসারীদের নিয়ে লাক্কাতুরা পাহাড়ের ওই টিলায় গিয়ে কাঠ কাটেন।'

'ফিরে আসার পর তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করেন যে আজ আমরা যে কাজ করলাম তা কার কাজ। সবাই উত্তর দিলো কাঠুরিয়ার কাজ। তখন তিনি সবাইকে বললেন যে ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী সব মানুষ সমান। তারপর সেই কাঠুরিয়ার কথা জানিয়ে তার সঙ্গীদের মধ্যে কে কে তার কন্যাদের বিয়ে করতে রাজি তা জানাতে বললে অনেকেই রাজি হন। তখন তাদের মধ্যে থেকে বেছে কাঠুরিয়ার মেয়ের বিয়ে দেন হজরত শাহ জালাল (রা.),' বলেন মোতাওয়াল্লী।

এ ঘটনার মাত্র ২১ দিন পর ইন্তেকাল করেন হজরত শাহ জালাল (রা.)। সিলেট বিজয় দিবসে কেটে আনা লাকড়িতেই তার ওরসের শিরনি রান্না করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ২৬ শাওয়াল লাকড়ি তোড়া উৎসব পালন করছেন হজরত শাহ জালাল (রা.) এর অনুসারীরা।

সিলেট বিভাগীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে এবং বড় হয়ে একা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করছি। লাকড়ি তোড়ার উৎসব সর্বজনীন। এখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ মানুষ হজরত শাহ জালাল (রা) এর সমতার শিক্ষাকে ধারণ করে আসেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করতে এ উৎসব শত শত বছর ধরে ধারণ করছেন সিলেটের মানুষ এবং হজরত শাহ জালাল (রা) এর অনুসারীরা।'

Comments

The Daily Star  | English

Driest April in 43 years

Average rainfall in Bangladesh was one millimetre in April, which is the record lowest in the country since 1981

12h ago