শ্রদ্ধা

হাসানরা একাই লড়াই করে যায়

বাঙালির বুদ্ধিজীবীতায় ধ্রুপদী এক নাম হাসান হাফিজুর রহমান। জন্মেছিলেন ১৯৩২ সালের ১৪ জুন, মারা যান ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল। মাত্র একান্ন বছরের স্বল্পরেখার জীবন।  ক্ষণজীবনকে তিনি রাঙায়িত করে গেছেন নানাভাবে, যার নজির ছিল না সমসময়ে, এমনকি আজও নয়। স্বল্পরেখার জীবনকে সৃজন ও মননশীলতায় নিয়ে গেছেন মহাকালের অসীমতায়।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বাঙালির বুদ্ধিজীবীতায় ধ্রুপদী এক নাম হাসান হাফিজুর রহমান। জন্মেছিলেন ১৯৩২ সালের ১৪ জুন, মারা যান ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল। মাত্র একান্ন বছরের স্বল্পরেখার জীবন। ক্ষণজীবনকে তিনি রাঙায়িত করে গেছেন নানাভাবে, যার নজির ছিল না সমসময়ে, এমনকি আজও নয়। স্বল্পরেখার জীবনকে সৃজন ও মননশীলতায় নিয়ে গেছেন মহাকালের অসীমতায়। 

হাসানের জন্ম অবিভক্ত ভারতে-ব্রিটিশ শাসিত সময়ে। ব্রিটিশ যখন নিচ্ছে বিদায় এবং ভারত হচ্ছে স্বাধীন ও খণ্ডিত, তখন সদ্য কিশোর। পাকিস্তান নামক অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের যাত্রা ও এক কিশোরের যৌবনযাত্রা একই দ্বৈরথে তবে বিপরীত মাত্রায়, ঝাঁকের কৈ হয়ে নয়।

বাঙালির পুনর্জন্ম ও বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসকে আলোকবিস্তারী করতে হাসান পালন করেছেন অসামান্য এক বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা। ইতিহাসের সঙ্গে থেকেছেন শিরদাঁড়া সোজা করে। ইতিহাসের বিনির্মাণে নির্মাণ করেছেন তুলনারহিত সব উদাহরণ। যা থেকে দীপিত হওয়ার ঐশ্বর্য রয়েছে অজস্র। আগুনের পরশমণি সম এক প্রাণ ছিল তার। যার ছোঁয়ায় আলোকিত হওয়া যায় নিজেকে-আলোকিত করা যায় দেশ ও জাতিকে।

হাসানের দীপ্রতায় ধন্য সেই আলোর পথে নেই কেউ। হাসান বড্ডো বেশি নিঃসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের মতো একলা কাঁদেনও নিশ্চয়? যে বাঙালিত্বের জন্য বাজি রেখেছিলেন আপন জীবন, বিক্রি করেছিলেন মায়ের গহনা। যে সাংবাদিকতার নীতি ও নৈতিকতাকে উচ্চকিত করতে, মহিমা ও মর্যাদা দিতে চাকরীচ্যুত হয়েছিলেন, যে দলিলপত্রের নিরপেক্ষ বিচারে-নির্মোহ উপস্থাপনে রোগ-শোক-ব্যাধিকে করেছিলেন তুচ্ছ। সেই বাঙ্গালির কবি-সাংবাদিক-সংস্কৃতিজনরা কি হাসানের পথের পথিক হতে পেরেছেন? বুদ্ধিজীবীতাকে জ্ঞান করতে পেরেছেন সকল অন্ধকার দূর করার প্রার্থনালয় ও প্রার্থিত মন্ত্রবিশেষ? যদি না হন তাহলে প্রশ্ন জারি রাখা জরুরি-সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত যে, হাসানের উত্তরসূরিরা কোথায়? কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমনটা বলেছিলেন, 'কবিরা কোথায় আজ/ সবাই কি দুর্যোধনের কেনা,/ নাকি বিরাট রাজার ক্রীতদাস?

কেউ যায় যুদ্ধে কেউ যায় ভিক্ষায়। কৈশোরত্তীর্ণ বয়সেই হাসান বেছে নেয় যুদ্ধের জীবন। ক্ষমতাবলয়ের-ক্ষমতাকাঠামোর লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে জীবনকে দেখার, সমাজ-রাষ্ট্র-বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার লক্ষ্যে কবির ধর্ম পালন পালনের ব্রত। এ পথই হাসানকে রাজনীতি সংলগ্ন করে তোলে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাসলত বোঝার আতসীকাঁচ হয়ে ওঠে। হাঁটি হাঁটি পা পা বয়সেই দেশটি সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে। কলমের শক্তিকে পুঁজি করে রুখে ওঠেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। প্রকাশ করেন দাঙ্গাবিরোধ পাঁচটি গল্পের সংকলন। বয়স তখন মাত্র আঠারো। যাকে সাক্ষী রেখে সুকান্ত লিখেছিলেন, 'আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।… এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়/ পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,/ এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়- এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।' কবির প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন আরেক কবি-যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে। দায় মিটিয়েছিলেন ইতিহাসের।

হাসানের আঠারো রূপে যে যাত্রা বিশে এসে তা হয়ে উঠেছিল কিম্ভূত রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য সমূহ মাথা ব্যথার কারণ। তখন বায়ান্নো, বাঙালির জাগরণ ও পুনর্জন্মের ক্ষণ। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ। হাসান ও অলি আহাদ আলাপরত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। অলি আহাদ বললেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওখানে যেতে। কিছু ছাত্র তখন ইট পাটকেল ছুড়ছে পুলিশের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে। তিনি বললেন, 'ওখানে গিয়ে ওদের থামতে বলো। তা না হলে ওরা গুলি করতে পারে।' 

হাসান গেলেন-নিষেধও করলেন, কিন্তু ওরা শুনল না। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল হাসান নিজেও ইট পাটকেল ছোড়া শুরু করেছেন। একটা টিয়ারশেল এসে সামনে পড়ে। ফাটে না। কিন্তু ওটাই যখন উল্টোদিকে ছুড়ে মারেন, ফাটে। গোলাগুলি শুরু হয়। বরকত যখন গুলিবিদ্ধ হয়, হাসান তখন ওখানকার গেটে। হাসান এবং মুর্তজা বশীর অন্য একজন আহতকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

এই সময়ে হাসান হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অংশ। যদিও ইতিহাসের আরেক কালপর্ব অপেক্ষা করছিল তখনও । ইতিহাসের ভেতর থেকে নাকি ইতিহাসকে অবলোকন করা যায় না। ইতিহাসের চাপা পড়ে যায় প্রকৃত ঘটনা। নানা চাপানউতোরে হোঁচট খায় মূলস্রোত। কিন্তু হাসানকে এসবের কিছুই ছুঁতে পারে না। কারণ, আঠারোয় হাসান ঠিক করে ফেলেছিলেন তার ভূগোল ও ভগবান। হাসান কিবলা চিনেছিলেন, একজন প্রকৃত প্রতিভার সহজাতগুণে, ধ্রুপদী বুদ্ধিজীবীর ওজস্বিতায়। সম্পাদনা করেন একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন।

হাসান হাফিজুর রহমান 'একুশে ফেব্রুয়ারি' সংকলন গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ' একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি এমনি এক যুগান্তকারী দিন। শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের এই ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপী যে সংগ্রাম, একুশে ফেব্রুয়ারি তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।' 

কী সাংঘাতিক কথা, একুশের ঘটনার এক বছরের মধ্যে হাসানের সম্পাদিত গ্রন্থে বলা হচ্ছে, 'একুশে ফেব্রুয়ারি সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা।' একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে ওই সত্য আক্ষরিকভাবেই প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগে পরাধীনভূমে দাঁড়িয়ে কতোটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে ওরকম সোনায় মোড়ানো কথা বলা যায়? সত্যিই সেদিন একবিন্দু বাড়িয়ে বলা হয়নি, করা হয়নি সত্যের অপলাপ। একুশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় স্বীকৃত-বিশ্বজুড়ে সম্মানিত। যে একুশের বৌদ্ধিক বীজ রোপিত হয়েছিল হাসানের পৌরহিত্যে। একুশে বাঙালির প্রাণের বাতিঘর-বাংলাদেশের জন্মের পবিত্র ভ্রূণ, হাসান হলেন এসবের বৌদ্ধিক নায়ক। হাসান শুধু নিজে লেখেননি, অন্যের লেখা সংগ্রহ করেননি, অর্থনৈতিক দিক সামলাতেও রেখেছিলেন সাহসী এক ভূমিকা-তুলনারহিত উদাহরণ।

একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান লিখেছেন , 'তেপ্পান্ন সালের প্রথমদিকে হাসান প্রস্তাব দিল, '৫২-এর উত্তাল ভাষা-আন্দোলনের সময়ে আমাদের দেশের সুধী লেখকসমাজ তুলির কলমের আঁচড়ে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, পুস্তকারে তা প্রকাশ করা যায় কিনা। … সেই সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বইটা বের করতে সেই ‍মুহূর্তেই ৫০০ টাকার প্রয়োজন। আমার আর হাসানের হাতে ৫০ টাকাও নেই। সমাধান করে দিল হাসান। বাড়িতে গিয়ে জমি বেচে সে টাকা নিয়ে আসবে। যা ইচ্ছা তা চিন্তা হাসান তাই করল। কথা দিলাম বই বিক্রি করে তার টাকা ফেরত দেবো। বই আমরা ছেপেছিলাম, বইয়ের প্রচারও যথেষ্ট হয়েছিল, ক্রেতারও ভিড়ও হয়েছিল। বইটার দাম রেখেছিলাম আড়াই টাকা। ১৯৫৩ সালের মার্চের শেষদিকে বইটা বেরুল আর সে বছরই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। ১৯ তারিখের দুপুরে লালবাগ থানার দুই ট্রাক পুলিশ এসে দোকান তছনছ করে দিয়ে গেল।… ছাপান্ন সাল পর্যন্ত বইটি সরকার কর্তৃক বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছিল। (আবদুল মান্নান সৈয়দ, 'একুশের প্রথম সংকলন')

হাসানের সহোদর খালেদ খালেদুর রহমানের জবানিতে জানা যায়, জমি নয় মায়ের গহনা বিক্রি করে 'একুশে ফেব্রুয়ারি' সংকলনের টাকা যুগিয়েছিলেন। এরকমই ছিলেন হাসান। কেবল কবি নন, কেবল সাংবাদিক নন, কেবল সম্পাদক নন- এসবেরও অধিক ছিলেন। আর এখানেই হাসানের বুদ্ধিজীবীতার মহত্তম উদাহরণ, অদ্বিতীয় অর্জন।

সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, '১৯৫৩ সালেই হাসান ছাড়া আর কে ভাবতে পারতেন আমাদের ভেতরে যে, একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ, তার বপন, তার লালন, তার পরিচর্যায় লেখকদের প্রত্যক্ষ অংশ নিতে হবে।'

একুশে ঘিরে যে দায় পালন করেছিলেন হাসান, তা জারি ছিল মৃত্যু অবধি। বায়ান্নর পূর্ব এবং পরও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হাসান ছিলেন সক্রিয় যোদ্ধা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগেই শুরু হয়েছিল তার বৌদ্ধিক যুদ্ধ। সেই সময় এমন কোনো সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল না, যারা প্রগতিপন্থায় সমর্পিত অথচ হাসানের সেখানে উজ্জ্বল উপস্থিতি নেই।

মুক্তিযুদ্ধে হাসান হারিয়েছিলেন দুই সহোদর। স্বাধীন দেশে স্বপ্ন দেখেছিলেন সবকিছু নতুন করে সাজানোর। মানুষের দুঃখমোচনের জন্য যে লড়াই জারি রেখেছিলেন দুই যুগ ধরে। এবার সবকিছু উসুল হবে। হাসি ফুটবে সাধারণ মানুষের মুখে। বৈষম্য দূর হবে সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে। জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। বাক স্বাধীনতা রক্ষিত হবে। বিকশিত হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আমলারা সত্যিই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিজেরদের দায়িত্ব পালন করবে। সমাজ রাষ্ট্রে অন্যায়কে অন্যায় বলার সুযোগ তৈরি হবে। প্রশ্নকরার অধিকার থাকবে সবার। স্বাধীনতার সুফল কেবল ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া অধিকার হয়ে উঠবে না, আম জনতার সমঅধিকারকেও নিশ্চিত করবে। স্বাধীনতার অর্জন কেবল পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেশ লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে-ব্রিটিশের একশ নব্বই বছরে যতো অপ্রাপ্তি ঘটেছে-অন্যায় অবিচার দুর্নীতি হয়েছে সেসব রুখে দিয়ে শুদ্ধতাকে নিশ্চিত করবে। কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতা নয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মনৈতিক সকল স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। কিন্তু স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় হোঁচট খেল হাসানের খোয়াব-স্বপ্নের বাংলাদেশ।   

হাসান নানারকম পেশায় ‍যুক্ত ছিলেন। তবে সাংবাদিকতায় ছিলেন অনেকটা সময় জুড়ে। পাকিস্তান আমলে নানা পত্রিকায় চাকরি করে থিতু হয়েছিলেন দৈনিক পাকিস্তান-এ। সরকারী পত্রিকা কিন্তু মাথা বিকোননি কখনো। হাসানের ধাতেও নেই সেটা। দেশ স্বাধীনের পর হাসান দৈনিক বাংলা'র সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি হন-শুরু হয় বাংলাদেশ অধ্যায়ের কর্মজীবন। সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও হন।

১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি রাজধানীতে ঘটে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এক শোভাযাত্রা বের কর সমাজতন্ত্রীদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন। মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে যখন ওরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তখন পুলিশ আচমকা গুলি করে। এতে মতিউল কাদেরসহ দুজন নিহত হন। এ খবর প্রকাশের লক্ষ্যে দৈনিক বাংলা বিশেষ টেলিগ্রাম প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়তে হাসান লেখেন, 'এত বড় একটি মর্মান্তিক ঘটনা কী করে ঘটতে পারল স্বাধীনতা-উত্তর পটভূমিতে , এ আমাদের বুদ্ধির অগম্য। এত লোকের মধ্যেও আবার নতুন লোকের আঘাত সইতে হবে, কী করে তা বিশ্বাস করা সম্ভব।'

গণমাধ্যমের নৈতিকতার জায়গা থেকে জাতির প্রতি দায় পালনের এই সাংবাদিকতাকে ভাল ভাবে নেওয়া হয় না। তাঁকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু তিনি যে নির্ভীকতা, দায়িত্ববোধ, জনহিতৈষণার পরিচয় দেন, তা অনন্য-সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্য গর্ব ও গৌরবের। একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলকের সম্পাদকের দায় যে শেষ হওয়ার নয়, বুদ্ধিজীবীর ছাতা যে সুযোগ বুঝে বন্ধ হওয়ার নয়, হাসান সেটা প্রমাণ করেছেন চাকরি খুইয়ে-অন্যদের বিরাগভাজন হয়ে। বায়ান্নো থেকে বাহাত্তরের এই যাত্রা হাসানকে পূর্ণতা দেয় বুদ্ধিজীবীর ধ্রুপদী তালিকায় নাম লেখায় সোনার হরফে।

একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের সম্পাদককে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের দায়ে করা হয় দেশান্তরী। সারা জীবন যিনি কবিতা চর্চায়-সাংবাদিকতায়-লেখালেখিতে-সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে-সাংগঠনিক ভূমিকায় ও জনকল্যাণের প্রশ্নে দেশপ্রেমের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তাকেই অবনমন দিয়ে চেনা মানুষ-চেনা চৌহদ্দি থেকে দূরে পাঠিয়ে হতাশাগ্রস্ত এক জীবনের দিকে রাষ্ট্রের প্রযত্নে ছুঁড়ে ফেলা দেয়া হয়। এ ঘটনা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে, দেহে দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধে। কিন্তু হাসান বৃন্তচ্যুত হয় না।

স্বল্পরেখার জীবনের একেবারে শেষাশেষি এসে হাসান আরেক দায়িত্ব পালন করে, যা কেবল তাকেই মানায়। একি কাকতাল নাকি ইতিহাসের অনিবার্য দায় পালন, তা জানার উপায় নেই। হাসানের সম্পাদনায় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র। ষোলোখণ্ডের এই কাজ হাসানকে অন্য এক মর্যাদায় সমাসীন করে। হাসান এই কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছেন নিরপেক্ষতায় তিনি কতো নির্মোহ ও অবিচল। সম্পাদকের প্রযত্ন ও পৌরহিত্যে যখন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জি ও দলিলপত্র প্রকাশিত হয় তখন মনে হয় এ বুঝি ইতিহাসেরই চাওয়া। ইতিহাস তার নায়ককে পূর্ণতা দেন এভাবেই।

তবে হাসানের এসব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না কখনোই। মহৎ মানুষেরা বুঝি এমনটাই হয়। এক সাক্ষাৎকারে সেই ভাষ্য স্পষ্ট হয়েছে এভাবে, 'এসব কাজ যারা করে তারা স্বভাবতই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, প্রকাশ্যে দেখা যায় অনেকেই এর প্রভাবে গড়ে উঠেছেন, ধারালো হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। কিন্তু সংগঠক হিসেবে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আড়ালে থেকেই নিঃশেষিত হয়ে গেলাম। (সচিত্র সন্ধানী, ঢাকা ২৯ আগস্ট ১৯৮২)।

আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, 'তারুণ্যের যে অগ্নি সেদিন প্রজ্বলিত করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান আর তার সাথীরা, আজো তা অনির্বাণ, অনির্বাণই থাকবে চিরকাল। (আবদুল মান্নান সৈয়দ, 'একুশের প্রথম সংকলন'।) একরত্তি মিথ্যে নয় সৈয়দের এই উবাচ। দুঃখ হলো, হাসানের উত্তরসূরিদের দেখা নেই, আতসকাঁচেও তালাশ হচ্ছে না তাদের অবয়ব। 

মুখস্থ কবি সাহিত্যিক-মুখস্থ সাংবাদিক সম্পাদক ও মুখস্থ সংস্কৃতিজনদের ভিড়ে কেবল মুখোশপরা ভদ্রলোক আর 'বিরাট রাজার বিরাট ক্রীতদাস' দেখা যায়। হাসানের মতো কেউ নয়, হাসানরা একাই লড়াই করে যায়! 

Comments

The Daily Star  | English
Workers rights vs corporate profits

How some actors gambled with workers’ rights to save corporate profits

The CSDDD is the result of years of campaigning by a large coalition of civil society groups who managed to shift the narrative around corporate abuse.

12h ago