নাগলিঙ্গম: বর্ণে-বিন্যাসে বাহারি, সৌরভে সুমিষ্ট

ফুলটির পাপড়ি ও পরাগচক্র সাপের ফনার মতো বাঁকানো। তাই বাংলায় এর নাম নাগলিঙ্গম। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা শিবপূজায় নাগলিঙ্গম ফুল ব্যবহার করেন। ছবি: স্টার

মৃদু হাওয়াতেই দোল খাচ্ছে প্রকাণ্ড গাছগুলোর কাণ্ড ফুঁড়ে বের হওয়া বাহারি ফুলগুলো। বাতাসের দোলায় আর পাখির ঠোকরে এর কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়ছে গাছের তলায়। আশপাশে ছড়িয়ে আছে ফুলের সুমিষ্ট সৌরভ। গাছের গায়ে থরে থরে ধরে আছে গোলাকার গাঢ় বাদামি রঙের ফল।

গাছটির ফল দেখতে অনেকটা কামানের গোলার মতো। তাই এর ইংরেজি নাম ক্যানন বল। বাংলা নামটি আরও চমৎকার—নাগলিঙ্গম। কারণ এর ফুলের পাপড়ি ও পরাগচক্র সাপের ফণার মতো বাঁকানো।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগানো নাগলিঙ্গমের এই গাছগুলোর বয়স ৭০ বছরের বেশি, যা দেশের প্রাচীণতম এই কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বয়সের সমান। ছবি: স্টার

বাংলাদেশে গাছটি বেশ দুর্লভ। কিন্তু ঢাকার শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রধান গবেষণা কেন্দ্রের সামনে এক সারিতেই এমন ৪টি গাছের দেখা মিলবে। একই বয়সী আরও ৩টি গাছ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের ভেতরে।

নাগলিঙ্গমের সৌন্দর্যে অভিভূত উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা তার 'শ্যামলী নিসর্গ' গ্রন্থে লিখেছেন, 'আপনি বর্ণে, গন্ধে, বিন্যাসে অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। এমন আশ্চর্য ভোরের একটি মনোহর অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেক দিন আপনার মনে থাকবে।'

এই নিসর্গবিদের মতে, নাগলিঙ্গম ছাড়া বড় কোনো বাগান পরিপূর্ণ হয় না।

গাছের কাণ্ড ফুঁড়ে বের হয়ে আসা শতেক ফুলের দল। ছবি: স্টার

নাগলিঙ্গমের আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis। ১৭৫৫ সালের ফ্রান্সের উদ্ভিদবিদ জে এফ আবলেট এই নামকরণ করেন।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিনের ভাষ্য, ১৯৩৮ সালে বাংলাদেশের প্রাচীনতম এই কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পরপর নাগলিঙ্গম গাছগুলো লাগানো হয়। সে হিসেবে এখানকার প্রতিটা গাছের বয়স ৭০ বছরের বেশি।

ঢাকায় জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, বলধা গার্ডেন, কার্জন হল, নটরডেম কলেজের ভেতর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও কয়েকটি নাগলিঙ্গমের গাছ আছে। অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের বক্তব্য, সারাদেশ মিলিয়ে পূর্ণবয়স্ক এই গাছের সংখ্যা ৩০টির বেশি হবে না।'

নাগলিঙ্গমের ফুলের রং উজ্জ্বল গোলাপি। পাপড়ি ৬টি। বসন্তে যেমন শিমুল গাছতলা ঝরা ফুলে ভরে থাকে, নাগলিঙ্গমের তলাও তেমনি অজস্র পাপড়িতে ছেয়ে থাকে।

নাগলিঙ্গমের ফল দেখতে অনেকটা কামানের গোলার মতো। তাই এর ইংরেজি নাম ক্যানন বল। ছবি: স্টার

বর্ষায় ফুল ফোটার ভরা মৌসুমে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক মানুষ গাছগুলো দেখতে আসেন। ফুলের সৌরভে মোহিত হয়ে বসে যান সংলগ্ন পুকুর পাড়ের বেঞ্চগুলোতে।

নাগলিঙ্গমের ভেষজ গুণও অনন্য । ফুল, পাতা ও বাকলের নির্যাস থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি হয়। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এর নির্যাস। এই গাছ থেকে তৈরি ওষুধ পেটের পীড়া দূর করে। পাতার রস ত্বকের নানা সমস্যায় কাজ দেয়। ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে নাগলিঙ্গমের পাতার রস ব্যবহৃত হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরা শিবপূজায় নাগলিঙ্গম ফুল ব্যবহার করেন। ভারতে নাগলিঙ্গমকে 'শিব কামান' নামে ডাকা হয়।

এই প্রকাণ্ড বৃক্ষের পাতা লম্বা, ডগা সুচালো। শাখার সঙ্গে প্রায় লেগে থাকে। কাণ্ড ধূসর। কিন্তু ফুলের সৌরভ মন মাতালেও দেড়–দুই মাসে গাঢ় বাদামি রঙের ফলগুলো পেকে যখন খসে পড়ে, তখন সেগুলো পচে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়।

ফুলটির সৌরভের মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে অনেকদূর পর্যন্ত। ছবি: স্টার

অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের ধারণা, এ কারণেই গাছটি খুব বেশি লাগানো হয়নি। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ঢাকার বাইরে লালমনিরহাট রেল স্টেশন ও গাজীপুরে ৪টি নাগলিঙ্গম গাছ আমি দেখেছি। দেশের আরও কয়েকটি রেল স্টেশন এলাকায় এই গাছটি দেখা যায়। সবগুলো গাছের বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। এ থেকে ধারণা করি, এই গাছগুলো যিনি লাগিয়েছেন তিনি হয়তো রেলওয়েতে চাকরি করতেন।'

বাংলাদেশে দুর্লভ এই গাছটি টিকিয়ে রাখতে বছর কয়েক আগে নাগলিঙ্গমের চর শ চারা তৈরি করেছিলেন অধ্যাপক জামাল। পরে সেগুলো গ্রিন বাংলাদেশ নামের একটা ফেসবুক পেজের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। জামাল উদ্দিন বলেন, 'দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্কুল প্রাঙ্গণ, রাস্তার ধার ও পতিত জায়গায় লাগানো ওই চারাগুলো এখন বেড়ে উঠছে।'

নাগলিঙ্গম ছাড়া বড় কোনো বাগান পরিপূর্ণ হয় না। ছবি: স্টার

এ ছাড়া মিষ্টি সুবাসের এই ফুল থেকে খুব ভালো মানের সুগন্ধি অর্থাৎ পারফিউম তৈরির সম্ভাবনাও দেখছেন এই অধ্যাপক। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য, 'সারা পৃথিবীতে খুব দামি সুগন্ধিগুলো তৈরি হয় নাগলিঙ্গমের মতো এমন ব্যতিক্রমী ফুল থেকেই। এই ফুলের সৌরভের স্থায়িত্বও বেশি। ব্রাজিল, ইতালিসহ বেশ কিছু জায়গায় নাগলিঙ্গম থেকে সুগন্ধি তৈরির প্রচলন আছে। সেক্ষেত্রে চেষ্টা করলে বাংলাদেশেও এমনটি করা সম্ভব।'

Comments

The Daily Star  | English
How do we avoid a debt trap?

How do we avoid a debt trap?

The debt bubble is ominous, given Bangladesh’s narrow export base and heavy reliance on remittance inflows.

7h ago