চালের দাম বৃদ্ধিতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

ছবি: সংগৃহীত

দিনমজুর আজমত আলীর বাড়ি উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট জেলায়। এক সপ্তাহ আগেও তিনি ৪৪-৪৫ টাকা কেজি দরে মোটা চাল কিনতেন। তবে গতকাল বাজারে গিয়ে জানতে পারেন, চালের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ টাকায়।

এ বিষয়ে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার দৈনিক মজুরি বাড়েনি, এখনো ৩০০ টাকাই আছে। ফলে যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।'

সিলেটের বালুচর এলাকার শাহেদ আলীরও প্রায় একই অবস্থা। পেশায় তিনি কাঠমিস্ত্রি, কয়েক মাস আগেও কাঠের কাজ করে তিনি পরিবারের ভরণপোষণ করতেন।

তিনি বলেন, 'এখন যেভাবে চাল ও অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়ছে, তাতে আমি কুলিয়ে উঠতে পারছি না। সামান্য কিছু সঞ্চয় ছিল, সেটা খরচ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এখন সেটাও শেষের দিকে।'

গত এক সপ্তাহ ধরে খুচরা বাজারে মোটা এবং চিকন চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যার ফলে অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে।

গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে স্বর্ণার মতো মোটা চাল ৫২ থেকে ৫৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেও এর দাম ছিল ৪০ টাকা থেকে ৪২ টাকা।

বিভিন্ন ধরনের চিকন চালের দামের ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা। নাজিরশাইলের দাম এখন প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে ৯৫ টাকা। গত সপ্তাহে দাম ছিল ৮০ টাকা থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে।

রাজশাহীর কলেজ শিক্ষক আবু সালেহ বলেন, 'চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমার মতো সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে সেগুলোর ব্যয় মেটানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।'

'এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমরা কীভাবে বাঁচবো', জানতে চান আবু সালেহ।

দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতারা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেট, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, পিরোজপুর, বরিশাল ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চালের বাজার ঘুরে জানতে পারেন, গতকাল যেকোনো জাতের চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৫২ টাকা কেজি।

খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় পাইকারি বিক্রেতারাও সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন এবং দাম বৃদ্ধির জন্য পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন তারা।

তবে ধান ও চাল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির জন্য বড় মিলারদের দায়ী করছেন পাইকাররা।

অপরদিকে রাইস মিলাররা জানান, কৃষকরা বেশি দামে ধান বিক্রি করছেন। এ ছাড়া, জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে বলেও দাবি করছেন তারা।

বন্যার কারণে বোরো ধানের উৎপাদন কম হওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বৃদ্ধির ফলে চালের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে গত এক মাস ধরে চালের দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

মিলাররা জানিয়েছেন, বড় ব্যবসায়ী ও পাইকারি বিক্রেতাদের একটি সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়েছে।

এমনকি সরকার গত মাসে চালের আমদানি শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার পরও আমদানি কম হওয়ায় বাজারে এখনো তার কোনো প্রভাব পড়েনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আমদানি শুল্ক কমানোর পর, গত ১ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ২৬ হাজার ৮৫০ টন শস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যদিও সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি এবং নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আমন ধান ওঠার আগে সেগুলো বাজারজাত করার অনুমতি দিয়েছে।

নওগাঁর ধান-চাল মজুতকারী ও পাইকারি বিক্রেতা সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের উল্লেখ করে বলেন, 'সরকার আমদানি শুল্ক কমানোর পর ভারতের বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আমদানি বন্ধ রেখেছেন।'

গত ১ আগস্ট ভারতের 'দ্য ইকোনমিক টাইমস'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ, ইরাক, ইরান ও সৌদি আরবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জুনের শুরু থেকে সব ধরনের চালের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

এর ফলে সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

দোষারোপের খেলা

পিরোজপুর শহরের চাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমানুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, পাইকারি বাজারে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

তার দাবি, 'চালের দাম বাড়তে শুরু করলে পাইকাররা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং চাহিদার চেয়ে কম পরিমাণে সরবরাহ করে।'

আমানুল্লাহ বলেন, 'পাইকার ও মিলাররা চালের দাম বাড়ার জন্য দায়ী এবং তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে।'

সিলেট জেলা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বন্যার কারণে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বোরো উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এ ছাড়া, বন্যার কারণে প্রথম দফায় দাম বাড়লেও জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের খরচ বেড়ে গেছে।'

তার দাবি, 'ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে।'

তবে পাইকারি ও ছোট মিলাররা বলছেন, বড় মিল মালিকরাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন।

রাজশাহীর কামাল অটো রাইস মিলের মালিক মো. কামাল উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বড় মিলাররা এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তাদের কাছে এত বেশি মজুদ রয়েছে, যে তাদের মধ্যে অনেকেই চাল সংরক্ষণের জন্য আমাদের গুদাম ভাড়া করছেন।'

এ আর স্পেশালাইজড রাইস মিলের মহাব্যবস্থাপক আখতারুজ্জামান রাসেলের দাবি, কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

এ ছাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও পরিবহন খরচ ২ থেকে ৩ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

গত ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের কাছে ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টন চাল এবং ১ লাখ ২৯ হাজার টন ধানসহ ১৮ লাখ ৭৬ হাজার টন শস্য মজুদ রয়েছে।

দেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩ কোটি টন চালের প্রয়োজন হয়। বেসরকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বেশিরভাগ চাল মজুত রয়েছে, যারা মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।

বাজার পর্যবেক্ষণ

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর সাবেক গবেষণা পরিচালক ডক্টর এ এম আসাদুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শুধু সমাজের দরিদ্র অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সীমিত আয়ের মানুষও এই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।'

তিনি পরামর্শ দেন, সরকারের উচিত বাজার পর্যবেক্ষণ করে বড় ব্যবসায়ী ও রাইস মিল মালিকদের কাছে দাম বাড়ানোর কারণ জানতে চাওয়া।

তিনি বলেন, 'সরকার যদি কারণ জানতে পারে, তাহলে দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।'

যোগাযোগ করা হলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসমাইল হোসেন অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো চালের দাম বাড়াচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে দাম বেড়েছে এমনটা নয়। তারা (ব্যবসায়ী ও মিলাররা) ইতোমধ্যেই চাল ও ধান মজুদ করে রেখেছেন। তারা যদি জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, তাহলে তাদের দাম বাড়ানো উচিত ছিল বড়জোর ১ টাকা।'

বাজার পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সচিব বলেন, 'দেশের প্রতিটি বাজার পর্যবেক্ষণ করার মতো পর্যাপ্ত জনবল সরকারের নেই।'

আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত চাল আমদানির সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'খোলা বাজারে বিক্রয় কর্মসূচির আওতায় সরকার আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসে আড়াই লাখ টন চাল বিক্রি করবে। আমরা নিশ্চিত করবো, যেন গরিব মানুষ সস্তায় চাল পায়।'

Comments

The Daily Star  | English

India bans select jute, fabric imports from Bangladesh via land routes

Today's action by DGFT came a little more than one month after India had imposed port restrictions on the import of certain goods like readymade garments and processed food items from Bangladesh via land routes

43m ago