মরিশাসে বাংলাদেশি অভিবাসীকর্মীকে ধর্ষণ ও প্রতারণার অভিযোগ

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

পরিবারের দারিদ্র্য দূর করতে ৩ বছর আগে সেলাই মেশিন অপারেটরের কাজ নিয়ে মরিশাসে যান রোকসানা (ছদ্মনাম)।

পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে যাওয়ার খরচ জোগাতে তাকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়েছিল। ২০১৯ সালের মে'তে ফায়ারমাউন্ট টেক্সটাইলস লিমিটেডে যোগ দেওয়ার ১ মাস পার হতে না হতেই তার উন্নত জীবনের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়।

রোকসানার অভিযোগ, কারখানার মালিক, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মরিশাসের ব্যবসায়ী অনিল কোহলি ১ বাংলাদেশিকর্মীর সহায়তায় তাকে বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করেন। একইসঙ্গে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে রাখেন এবং এ বিষয়ে কথা বললে তা প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দেন।

বিদেশি রাষ্ট্রে আরও বিপদের মুখে পড়ার ও বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রোকসানা সেই পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য হন। ফলে তার ওপর নির্যাতন অব্যাহত থাকে।

তিনি জানান, আরও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের এক নিরাপত্তাকর্মীকে বিয়ে করেন।

অবশেষে প্রতিষ্ঠানটি তাকে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর দেশে ফেরত পাঠায়। তখনো তার চুক্তির ৬ মাস বাকি ছিল। তিনি আরও জানান, ফেরত পাঠানোর সময় তার ৪ মাসের বেতন বকেয়া ছিল।

রোকসানা সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিশাসে গিয়েছিলাম। কিন্তু, সেখানে আমি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমি ন্যায়বিচার চাই।'

দেশে ফিরে জানুয়ারিতে ৩২ বছর বয়সী রোকসানা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এবং এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেন।

মরিশাসে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি বলে তিনি ডেইলি স্টারকে জানান।

এখন তিনি ধার করা অর্থে একটি বিপণি বিতান চালান। তিনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর অংশবিশেষ তিনি দোকান চালু করতে ব্যয় করেন এবং বাকিটা মরিশাসে যাওয়ার খরচ মেটাতে যে ঋণ নিয়েছিলেন, তা পরিশোধ করতে ব্যবহার করেন।

রোকসানার বাবা অন্য এক নারীকে বিয়ে করে তাদের ভরণপোষণের খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে তার পরিবার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে। সে সময় মা ও ৩ কনিষ্ঠ ভাইসহ ৫ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন তিনি। স্বভাবতই, ঢাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানার ন্যূনতম মজুরিতে সংসার চালাতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন।

মরিশাসের তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত এক নারী তাকে সেখানে চাকরি নেওয়ার পরামর্শ দেন। রোকসানা এক দালালের সহায়তায় পাসপোর্ট জোগাড় করেন এবং একটি নিয়োগদাতা এজেন্সির মাধ্যমে মরিশাসে পৌঁছান। এতে তার ১ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়, যার মধ্যে ৭০ হাজার টাকা তিনি ধার নেন।

নির্যাতনকারী চক্র

প্রথম কয়েক মাস সেখানে থাকার পর মুন্নি বেগম নামের একজন বাংলাদেশি সহকর্মী তাকে অনিল কোহলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরামর্শ দেন বলে অভিযোগ করেন রোকসানা।

তিনি বলেন, 'মুন্নি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এতে আমার আরও উপার্জন করতে ও প্রতিষ্ঠানের খরচে আরও বেশিবার বাংলাদেশে যেতে সুবিধা হবে।'

'মুন্নি জানান, এমনকি আমার ভাইরাও সেখানে চাকরি পেতে পারে', বলেন রোকসানা।

যখন তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তখন তার বেতন বন্ধ হয়ে যায়। মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা তাকে মুন্নির সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানায়। অভিযোগ মতে, মুন্নি কারখানা মালিকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

মুন্নির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি রোকসানাকে অনিলের কার্যালয়ে নিয়ে যান। রোকসানা দাবি করেন, সেখানে অনিল তাকে প্রথমবারের মতো ধর্ষণ করেন। তিনি আরও জানান, প্রতিবাদ জানালে অনিল ও মুন্নি তাকে মারধর করেন।

তিনি জানান, পরবর্তী ১ বছরে অনিল তাকে মোট ৬ বার ধর্ষণ করেন। এরপর ২০২০ সালের মে'তে তিনি ভারতীয় নাগরিক আনন্দ চৌহানকে বিয়ে করেন।

তিনি জানান, নির্যাতনের বিস্তারিত জানা সত্ত্বেও আনন্দ তাকে বিয়ে করেন।

তবে তার স্ত্রীর ওপর অনিলের অতীত নির্যাতনের ঘটনায় রাগান্বিত হয়ে আনন্দ ইউটিউবে একটি ভিডিও আপলোড করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশি নারীকর্মীদের এই প্রতিষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেন।

এ ঘটনার পর কারখানার মালিক তার বিরুদ্ধে একটি অবমাননার মামলা দায়ের করেন। ফলে আনন্দকে কারাগারে যেতে হয়। রোকসানা জানান, আনন্দ এখনো কারাগারে আছেন।

বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার ১ সপ্তাহ আগে রোকসানা পোর্ট লুইসে মরিশাসের কর্তৃপক্ষের কাছে অনিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার চেষ্টা করেন। তবে, কর্মকর্তারা তাকে বিষয়টি বাংলাদেশ হাইকমিশনে জানানোর অনুরোধ করেন।

বাংলাদেশ হাইকমিশনে একজন কর্মকর্তা তার অভিযোগ গ্রহণ করেন এবং বিষয়টি তদন্ত করার আশ্বাস দেন। তবে, তিনি ফিরে আসার আগে কেউ সেখানে তদন্ত করতে যায়নি বলে দাবি করেন রোকসানা।

দেশে ফেরার পর তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ দেন। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ রেহান উদ্দিন মরিশাসে নিযুক্ত বাংলাদেশি হাইকমিশনের প্রথম সচিবের (শ্রম) কাছে চিঠি দিয়ে তাকে এ বিষয়টির তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান।

প্রথম সচিব (শ্রম) সুমন আচার্যি ২১ ফেব্রুয়ারিতে মরিশাসের পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছে এ ঘটনায় ১টি চিঠি পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান।

মরিশাসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে তিনি বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে জুনে চিঠি পাঠিয়ে ভুক্তভোগীর আনা অভিযোগের অনূদিত নোটারি কপি পাঠানোর অনুরোধ জানান।

রোকসানা ডেইলি স্টারকে জানান, মন্ত্রণালয় তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং তিনি গতকাল নথিগুলো জমা দিয়েছেন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ডেস্কের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সারোয়ার আলম ডেইলি স্টারকে জানান, নথিগুলো রোববারের মধ্যে পাঠানো হবে।

একই অপরাধ আগেও করেছেন অনিল

এর আগেও অপর একজন বাংলাদেশি নারী অভিবাসীকর্মী অনিলের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ আনেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনিলের কারখানায় হেলপার হিসেবে যোগ দেওয়া ওই নারী (২৪) ২০২১ সালের ১১ জুলাই ঢাকার রামপুরা থানায় ৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে অনিল কোহলি ছাড়াও ছিলেন শাহ আলম নামে এক বাংলাদেশি নাগরিক, যিনি ফায়ারমাউন্ট টেক্সটাইলের কর্মীদের ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন।

নিয়োগদাতা এজেন্সির মালিকসহ বাকি ৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবপাচার ও ধর্ষণে সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল শাহ আলম তাকে অনিলের বাসায় নিয়ে যায়, যেখানে তিনি তাকে ধর্ষণ করেন।

পরবর্তীতে শাহ আলম ও অনিল উভয়ই তাকে বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করেন। তারা এই অপরাধের ভিডিওচিত্র ধারণ করেন এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

তদন্তের পর রামপুরা পুলিশ একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে বলা হয়, 'বাদীর বক্তব্যে প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে'। তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তারা এই মামলা নিয়ে আর অগ্রসর হতে পারবেন না, কারণ ঘটনাটি বাংলাদেশের বাইরে সংঘটিত হয়েছে।

প্রতিবেদন মতে, ওই নারী মামলা দায়ের করার পর আদালতের বাইরে এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন।

সেই নারীর সঙ্গে ডেইলি স্টার যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে চান না।

অনিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার আইনজীবী ডেইলি স্টারকে জানান, সব অভিযোগ মিথ্যে। আইনজীবীর মারফত তিনি দাবি করেন, তার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ আদায় ও তার স্বামীকে কারামুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে রোকসানা এসব অভিযোগ এনেছেন।

তিনি আরও দাবি করেন, রোকসানার পুরো বেতন পরিশোধ করা হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার ফিরতি যাত্রার উড়োজাহাজের টিকিটের খরচও বহন করা হয়েছে।

অন্য কর্মীর অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবী জানান, পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর একটি বাংলাদেশি আদালত মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করেছে।

ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে অনিলের তথাকথিত ২ সহযোগী মুন্নি ও তানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে, অভিযোগ সম্পর্কে শোনার পর তারা দাবি করেন, তারা রোকসানার বর্ণিত 'মুন্নি' ও 'তানিয়া' নন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
eid-ul-azha emergency cases at pongu hospital

An Eid evening at Pongu Hospital: overflowing emergency, lingering waits

The hospital, formally known as NITOR, is a 1,000-bed tertiary medical facility that receives referral patients from all over the country

3h ago