করোনাকালে জীবনের প্রাসঙ্গিক পাঠ
সর্বজনে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত শাইখ সিরাজ। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও পরবর্তীতে চ্যানেল আইয়ের কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান করে নিজে যেমন পেয়েছেন তারকা খ্যাতি, তেমনি দেশের কৃষি সংস্কৃতির পরিবর্তন-পরিবর্ধন-আধুনিকায়ন এবং প্রযুক্তিমুখী করার ক্ষেত্রে সদর্থক অর্থেই রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। কিন্তু করোনা মহামারি তাকে হাজির করেছেন 'লেখক' হিসেবে। 'করোনাকালে বহতা জীবন' পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা অন্য এক শাইখ সিরাজকে খুঁজে পাই।
জানার সুযোগ ঘটে তার ব্যক্তি জীবনের নানা উপাখ্যান-ফেলে আসা দিনগুলোর চুম্বকীয় স্মৃতি-সাম্প্রতিক সময়ের রোজনামচা এবং করোনাকালীন ঘটনামুখর দিনরাত্রির কথা। পর্দায় যেভাবে দেখি, সেটুকু তো এক জীবনের যৎসামান্য অংশ, ঘড়াই তোলা জল বিশেষ। এসবের বাইরের যে দীর্ঘ অধ্যায় সেটাই কিন্তু মুখ্য-যা থেকে যায় অজানা কিংবা জানা হলেও সেই সুযোগ পায় নির্দিষ্ট বৃত্তের-ঘর গেরস্থের সঙ্গে সম্পর্কিত কতিপয় মানুষ মাত্র। কিন্তু বৃহত্তর মানুষের জানার সুযোগ ঘটে কেবল বইয়ের মাধ্যমেই। বই পাঠ শেষে উন্মোচিত হয় আটপৌরে জীবনের নানা মুহূর্ত। যেমন ঘরোয়ায়-বন্ধুতায়-পেশাদারিত্বে-স্বজন সান্নিধ্যে- ছোট বড়ো সবার মাঝে-পদ ও বয়সের বাস্তবতায় নিজেকে মেলে ধরেন কীভাবে-কোনরূপে।
আলোচ্য বই শাইখ সিরাজকে জানা ও বোঝার জন্য খোলা জানালা বিশেষ। যদিও তিনি খুলে দেননি সবকটা জানালা। তারপরও লেখকের নির্বাচিত জানালার আলো-আধারিতে চোখ রেখে যা পাঠের সুযোগ পাই আমরা, মুগ্ধ হওয়ার, চমকে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। অবশ্য শুধু মুগ্ধ ও বিস্ময়াভিভূত হয়েই ক্ষান্ত হই না নিজের ভেতরে কিছু প্রশ্নেরও মুখোমুখি হই, অনিবার্যভাবে-সঙ্গতকারণেই। একের পর এক গল্প-ঘটনা ও চরিত্রের মুখোমুখি হতে হতে পাঠক মাত্রই এই ভাবনা অকিঞ্চিৎকর নয় যে, আচ্ছা এটুকু বললেন, ওটুকু কেন বললেন না। একজন পাঠকের অবশ্য এ খেদোক্তি চিরকালের, কারণ তার পক্ষে ততটুকুই পাঠ করার সুযোগ হয়, যতটুকু লেখক জানান-বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন এবং যাতে নিজের বিভিন্ন ধরণের প্রাপ্তিযোগ থাকে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির নান্দীপাঠ যতো মুখ্য হয়ে ওঠে-এবং কতিপয় মানুষের গুণকীর্তন এবং সম্পর্কের তরঙ্গগুলোকে জানানো এবং বোঝানো লেখকের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হয়- ততটুকু পাঠান্তে পাঠককে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কারণ এ ছাড়া তার কোনো গত্যন্তর নেই। বইটি সেই বয়ানের বাস্তবতার এক সাক্ষী বিশেষ।
করোনা কি কোনো শিক্ষা দিতে পেরেছে, সম্ভবত না। বরং করোনাকে আত্তীকরণ ও সাঙ্গীকৃত করে কীভাবে চলা যায় তার পথ বাতলে দিয়েছে। ফলে, ব্যক্তি মানুষ করোনার আগে ও পরের সময়ে এবং বর্তমানের বাস্তবতায় যা ছিল অনেকাংশেই তাই-ই রয়ে গেছে। 'যে লাউ সেই কদুর' এর মতো। করোনা পুরো পৃথিবীর জন্য বড়ো রকমের ধাক্কা ও অভিজ্ঞতা হলেও তার থেকে মানবসভ্যতা ও পৃথিবী নামক গ্রহের জন্য যা কিছু ইতিবাচক সেসব বাস্তবায়নে প্রত্যয়ী ভূমিকা নেওয়ার কোনো শিক্ষা নেয়নি কেউই। কিংবা নিলেও সেটা রয়ে গেছে অগোচরে এবং সংখ্যায় এতোটা অপ্রতুল যে তা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে।
শাইখ সিরাজের বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকার খিলগাঁওয়ে। আদি নিবাস-পিতৃভিটা চাঁদপুরে। একান্নবর্তী এক পরিবারের গল্প রয়েছে বইয়ে। যখন এই শহরের বাসিন্দারাও পশ্চিমাদের মতো ক্রমশ ছোট পরিবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, তখন তিনি ব্যতিক্রম। এখনও তারা ভাইয়েরা একসঙ্গে থাকেন। বাড়ির নামটাও সুন্দর 'সহোদর', চ্যানেল আইয়ে কর্মরত উনার সহকর্মী কবি আদিত্য শাহীন রেখেছেন এই নাম, যা তিনি উল্লেখও করেছেন বইয়ে। বইয়ের নামকরণ করেছেন আরেক সহকর্মী- শিশু সাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম, সেটাও বলেছেন ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করে। এগুলো তিনি না বললেও পারতেন, কিন্তু বলার মধ্য দিয়ে নিজেকেই গৌরবান্বিত করেছেন। জীবনের নানা বাঁকে ঘটে যাওয়া অধ্যায়সমূহের বিশদ উপস্থাপনের পাশাপাশি ব্যক্তির নাম ও সম্বোধনে শ্রদ্ধা ও সমীহ প্রকাশের সৌজন্যতা ও শিষ্টাচার বজায় রেখে।
'করোনাকালে বহতা জীবন' করোনাকালীন কয়েক মাসের গল্প। দিনপঞ্জির মতো করে তিনি লিখেছেন সন তারিখ ধরে ধরে। দেশে কীভাবে করোনার আঘাত এলো এবং তিনি কীভাবে গৃহবন্দী হয়ে পড়লেন সেই প্রসঙ্গ দিয়ে বইয়ের শুরু। ২০২০ সালের ২৩ মার্চ সোমবার লেখক ছিলেন চ্যানেল আইয়ের সংবাদ কক্ষে। এপ্রিলের ৯ তারিখ থেকে শুরু করেছেন রোজনামচা এবং ততদিনে গৃহবন্দি হয়েছেন 'সহোদর'এ। শেষ হচ্ছে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দুই তারিখ।
এই সময়কালে করোনাকে ঘিরে দেশে এবং বিদেশে যা কিছু ঘটেছে এবং যেসব গুরুত্বপূর্ণ অংশ গণমাধ্যমসমূহে এসেছে তার নির্বাচিত অংশ হাজির করেছেন লেখক। করোনার আঘাতেও চ্যানেল আইয়ের চব্বিশ ঘণ্টার সম্প্রচার কীভাবে অব্যাহত রইলো। ঢাকার ঢাউস আকৃতির প্রধান অফিস এবং অনেক লোকবল কমিয়েও ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো কাটছাঁট না করে। কীভাবে জুমের ব্যবহার শুরু হলো এবং এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হলো সামান্য কিছু কর্মীর নিষ্ঠায়, নেপথ্যের সেসব কাহিনীর সবটাই জানা যায় এই বইয়ের সুবাদে। সেক্ষেত্রে এই বইকে করোনাকালীন সময়ের বিশ্বস্ত এক দলিল বলা যায়। করোনার কাছাকাছি সময়ে দাঁড়িয়ে হয়তো এর গুরুত্ব ততোটা বোঝা যাবে না, যতোটা গুরুত্ববহ হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে। কেননা, করোনার অভিঘাত কতোটা সর্বনাশী এবং বহুধা ছিল তার সাক্ষী হিসেবে এই বই বিশ্বস্ত ও প্রয়োজনীয় এক আধার হয়ে উঠেছে। শাইখ সিরাজ রোজনামচার আদলে অনন্য এক কর্ম সম্পাদন করেছেন।
'করোনাকালে বহতা জীবন' পাঠান্তে জানা যায়, সহোদর-এ থেকেও কীভাবে তিনি পেশাদারিত্ব বজায় রেখেছেন এবং অন্যদেরকেও রাখতে উৎসাহী করেছেন। বস হয়েও কর্মীদের সঙ্গে কীভাবে মিশতে হয় এবং তাদেরকে আপন করে নিয়ে-সুখে দুঃখের সঙ্গী ও সমব্যথী হয়ে কীভাবে কাজটা বের করে নিয়ে আসতে হয় তার ধারাপাত রয়েছে এখানে। শুধু কি অফিস অর্থাৎ চ্যানেল আইয়ের মানুষদের প্রতি তার ভালবাসা, না মোটেই নয়। বরং তিনি খোঁজ রাখছেন 'সহোদর'-এর প্রত্যেকটা সদস্যের প্রতি। কেবল নিজের স্ত্রী-সন্তান নয়, সকলের প্রতি তিনি সমান আন্তরিক-দায়িত্বশীল ও প্রেমময় এক অভিভাবক। আবার পরিবারের সদস্যদের বাইরে বন্ধু-বান্ধব-পরিচিত-স্বল্প পরিচিত স্বজন-সতীর্থ-সুহৃদদের জন্যও তিনি উৎসর্গীকৃত এক হার্দিকজন। যিনি মোড়ের কুকুরটি না খেয়ে থাকলেও চোখ রাখেন সেদিকে, বুঝতে পারেন খাবার সংকটের বাস্তবতা এবং স্ত্রী পারুল ওরফে পারুর সঙ্গে কথা বলে কুকুরটির জন্যও একটা বন্দোবস্ত করেন।
শাইখ সিরাজ যে কতোটা কৃষি ও কৃষকপ্রেমী তার অনুপম সাক্ষ্য রয়েছে অনেকাংশেই। আমনের ক্ষতিকে, হাওরের বন্যায় তিনি কেবল উদ্বিগ্ন হন না, এসব ক্ষেত্রে যতোটা সম্ভব করার চেষ্টা করেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে চেষ্টা চালান ইতিবাচক সমস্যা সমাধানে। কখনো পুরোটা সফল হন, কখনো কিছুটা, কখনো কিছুই করতে পারেন না। কিন্তু তিনি হতোদ্যম হন না, চেষ্টা চালাতে থাকেন। কৃষি ভাবনা এবং কৃষি ও কৃষক নিয়ে তার চিন্তা-পরিকল্পনা-পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয় কৃষক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারক মহলেও।
লেখক করোনাকালে রাজধানী ঢাকার 'সহোদর' নামক এক বাসায় বন্দি থাকলেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি সচল রেখেছেন-ব্যস্ত থেকেছেন। পরিভ্রমণ করেছেন বিশ্ব মাঝারে। বলেছেন ফেলে আসা দিনগুলোর গল্প। শুনিয়েছেন জীবন চলার পথের নানা অভিজ্ঞতা। আমরা সেসবে বিস্মিত হয়েছি, জীবনের লড়াই এরকমও হয়। মিরপুরে নিজেদের জমি নিয়ে কী ঝামেলার মধ্য দিয়েই না যেতে হয়েছে। চীনে গিয়ে বিমানবন্দরে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তাও আমাদেরকে হতচকিত করেছে। আবার এও মনে হয়েছে, আচ্ছা লেখকের জীবনে কী কোনো অনুশোচনা নেই? সন্তানের চোখ লাল হওয়ার ঘটনার সঙ্গে যেভাবে নিজের জীবনের চোখে আঘাত প্রাপ্তির গল্পকে মিলিয়েছেন, সেভাবে কোনো ভুল-কাউকে বঞ্চনা- কাউকে ভুল বোঝা কিংবা আঘাত দেওয়া এসবওতো এসব মুহূর্তে মনে পড়ার কথা এবং সেটা বেশী করেই। কিন্তু 'করোনাকালে বহতা জীবন' এসবের প্রসঙ্গ নেই মোটেই।
বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে উল্লিখিত হয়েছে, 'প্রচলিত গবেষণা, আত্মজীবনী, প্রবন্ধের বই নয় এটি; নয় দিনলিপির বইও। করোনার কঠিন দিনগুলোতে লেখা হলেও শুধু করোনাকালীন বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিস্থিতি নয়- এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে শাইখ সিরাজের জীবনের নানা চড়াই-উতরাই, কৃষি উন্নয়ন ও অর্থনীতি চিন্তার নানা দিক। বলা যায়,পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশ ও এর উন্নয়ন দর্শনের গভীরে প্রবেশ করছেন লেখক নিজস্ব সরলতায়।' এটা কার অভিমত উল্লেখ না থাকায় ধরে নিতেই হয় প্রকাশক এই মতামত রেখেছেন। কিন্তু এই বই উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য বিশিষ্টতার কোনোটাকেই ধারণ করেনি-সম্ভবত লেখকের সেটা উদ্দেশ্যও নয়। আলটপকা এরকম মন্তব্যে যে কারও বিভ্রান্ত ও বিরাগ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেই অবকাশ কেনো দেওয়ার চেষ্টা করা হলো তা বোধগম্য নয়। প্রকাশক কিংবা যিনি এই নির্বাচিত অংশ লিখেছেন তিনি কি বইটা পড়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেননি, নিদেনপক্ষে উল্টে দেখার? এই বই কোনো উন্নয়ন দর্শনকে প্রতিপাদ্য জ্ঞান করেনি-পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শনের প্রসঙ্গতো কোনোভাবেই নয়।
Comments