সাবিনাকেও শুনতে হয়েছে ‘একটি মেয়ে কেন ফুটবল খেলবে’

বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার মেয়ে সাবিনা খাতুন। সোমবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সাবিনা সেই দলের অধিনায়ক। কিন্তু সাবিনার এ পর্যন্ত আসার গল্পটি মোটেও সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তাকে এখানে আসতে হয়েছে। মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন সাবিনা খাতুনের বড় বোন সালমা খাতুন। তার কথায় উঠে এসেছে মফস্বলের সেই ছোট্ট সাবিনার আজকের অদম্য সাবিনা হয়ে ওঠার গল্প।
ছবি সাবিনা খাতুনের ফেসবুক থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার মেয়ে সাবিনা খাতুন। সোমবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সাবিনা সেই দলের অধিনায়ক। কিন্তু সাবিনার এ পর্যন্ত আসার গল্পটি মোটেও সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তাকে এখানে আসতে হয়েছে। মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন সাবিনা খাতুনের বড় বোন সালমা খাতুন। তার কথায় উঠে এসেছে মফস্বলের সেই ছোট্ট সাবিনার আজকের অদম্য সাবিনা হয়ে ওঠার গল্প।

সাবিনার শুরু…

ছোটবেলা থেকেই সাবিনা খেলা অনুরাগী ছিলেন। তিনি শুধু ফুটবল খেলতেন না, সব ধরনের খেলায় পারদর্শী ছিলেন। শুধু তাই নয় সব খেলাতেই সেরা ছিলেন।

সাবিনার বোন সালমা খাতুন বলেন, 'ওর খুব ছোটবেলা থেকে খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল, ভালোবাসা ছিল। এখন তো অনেক ঠান্ডা স্বভাবের হয়ে গেছে। কিন্তু সাবিনা ছোটবেলা অনেক চঞ্চল ছিল, দুরন্ত ছিল। সব খেলাতেই ও ভালো ছিল। যে কোনো খেলাতে প্রথম ছাড়া কখনো দ্বিতীয় হত না। পড়ালেখাতেও খুব ভালো ছিল। কিন্তু খেলাকেই বেশি প্রাধান্য দিত। এমনও হয়েছে আগামীকাল পরীক্ষা, অথচ আগের দিন রাত ৮-৯টা পর্যন্ত অনুশীলন করছে। আমরা তাকে পড়ার জন্য চাপ দিতাম। কিন্তু ও বরাবরই খেলাকে প্রাধান্য দিত। তবে, রেজাল্ট খারাপ করত না।'

তিনি আরও বলেন, 'আরও আগের কথা যদি বলি সাবিনা স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগ রেখে মাঠে চলে যেত। মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। ও প্রাইমারি থেকেই সব জায়গায় খেলতে যেত। হাইস্কুলে ওঠার পর খেলাতে আরও মনোযোগী হলো। ওর এক ম্যাডাম ছিলেন রাফিয়া ম্যাম। যেখানেই খেলা হতো রাফিয়া ম্যাম ওকে নিয়ে যেতেন। কারণ ও সবার চেয়ে ভালো খেলত।'

ছবি সাবিনা খাতুনের ফেসবুক থেকে নেওয়া

সমালোচনা

'একটি মেয়ে কেন ফুটবল খেলবে' এই কথা যেন আমাদের সমাজের জন্য একটি ট্যাবু। সাবিনাকেও এ কথা শুনতে হয়েছে। তবে, এসব কথাকে পাত্তা দেননি সাবিনা ও তার পরিবার।

এ বিষয়ে সাবিনার বোন বলেন, 'যেহেতু সাবিনা একজন মেয়ে। তাও দক্ষিণাঞ্চলের একটি মফস্বল শহরের। এজন্য শুরু থেকে নানা বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। মানুষতো একটি মেয়ের ফুটবল খেলাকে ভালো চোখে দেখেন না, সাবিনাকেও দেখতেন না। তারা বলতেন, একটি মেয়ে কেন ফুটবল খেলবে।'

'আসলে মানুষ তো অনেক কথা বলবে। কিন্তু, সব কথাকে তো আর পাত্তা দিলে হবে না। কে কী করল, কে কী বলল- আমরা সেভাবে গুরুত্ব দেইনি। আমাদের তখন অনেক অভাব ছিল। কেউ কিন্তু দুটো টাকা দিয়ে সাহায্য করেননি, তবে ঠিকই সমালোচনা করতেন। মানে সমালোচনার বেলা অনেকেই ছিলেন, সাহায্যের বেলাতে কেউ ছিলেন না। অথচ যেসব মানুষ তখন সমালোচনা করতেন তারাই এখন ধন্য ধন্য করছেন। তাই বলব, তখন যদি তাদের কথা শুনতাম তাহলে তো আমার বোন আজ এ পর্যন্ত আসতে পারত না,' বলেন তিনি।

সাবিনার সাপোর্ট

সাবিনাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়ে গেছেন বাবা, কোচ আকবার এবং বড় বোন। আর সে কারণেই আজ এতদূরে আসতে পেরেছেন সাবিনা।

সালমা খাতুন বলেন, 'সবচেয়ে সাপোর্ট বলতে গেলে ফ্যামিলি থেকে বাবা ছিল, বড় আপু ছিল। আমার বাবা ২০২০ সালে মারা গেছেন। আরেকজনের কথা বলতেই হবে- সাবিনার কোচ আকবার স্যার। উনিও মারা গেছেন। আকবার স্যারের কারণেই আজ সাবিনা এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। সাবিনা হয়ে ওঠার পেছনে হয়তো আমাদের পরিবারের সাপোর্ট ছিল, কিন্তু অবদানটা বেশি আকবার স্যারের। উনি তো সাবিনাকে প্রশিক্ষণ দিতেন। আজ স্যার বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন।'

ছবি সাবিনা খাতুনের ফেসবুক থেকে নেওয়া

পরিবারের হাল ধরা

বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে হয় সাবিনাকে। ফুটবল খেলে খুব বেশি টাকা পাওয়া যায় না। তবুও যা পেতেন তা দিয়েই সাবিনা পরিবারের পাশে দাঁড়ান।

এ ব্যাপারে সাবিনার বোনের ভাষ্য, 'বাবার মৃত্যুর পর সাবিনার আয় দিয়েই পরিবারের বেশিরভাগ খরচ চলত। যেটুকু টাকা পেত তা দিয়েই ম্যানেজ করতে হত। জানেনই তো, ওরা খেলা করে, পরিশ্রম করে- কিন্তু খুব বেশি টাকা পাই না। ক্রিকেটারদের বাড়ি-গাড়ি আছে কিন্তু ফুটবলারদের কিছু নেই। নারী ফুটবলারও যদি এমন সুযোগ-সুবিধা পেত তাহলে আরও ভালো করতে পারত। সরকারের উচিৎ এই মেয়েগুলোর পাশে দাঁড়ানো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ- আপনি এই দলটির পাশে দাঁড়ান।'

সাবিনার স্ট্রাগল

সাবিনার পরিবারে ছিলেন ৭ সদস্য। বাবা ছিলেন তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। তাই স্বাভাবিকভাবেই সাবিনাকে স্ট্রাগল করতে হয়েছে। সাবিনার বোনের মুখে সেই স্ট্রাগল বা লড়াইয়ের কথা উঠে এসেছে।

তিনি বলেন, 'বাবা খুব কষ্ট করেই আমাদের বড় করেছেন। বুঝতেই পারছেন আমাদের পরিবারে ৭ জন সদস্য ছিল। সবাইকে নিয়ে বাবা লড়াই করেছেন, পরিশ্রম করেছেন। বাবার আয়ে আমাদের পড়ালেখা, খাওয়া সব চলত। আবার আমরা ভাড়া থাকতাম। সবমিলিয়ে তখন খুব কঠিন সময় পার করেছি। কিন্তু, কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। সাবিনাকে তখন অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই খেলা করতেও তো একটা খরচের বিষয় থাকে। ওই কঠিন সময়ে আমি একটি ক্লিনিকে কাজ করতাম। বাবার পাশাপাশি আমিও যতটুকু পেরেছি সাপোর্ট দিয়েছি।'

তিনি আরও বলেন, 'ওই সময়ে সাবিনা ২ জোড়া জুতা ব্যবহার না করে এক জোড়া জুত ব্যবহার করত। দুইটা জার্সি লাগলে ও একটা জার্সি পরত। কিন্তু ও কখনো হাল ছাড়েনি বা ভেঙে পড়েনি। কারণ সাবিনার আইকন ছিল আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার লিওনেল মেসি। সাবিনা সবসময় বলত, আমি যেন মেসির মতো হতে পারি।'

'আমি চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন তাদের দিকে একটু সুদৃষ্টি দেন। কারণ নারী ফুটবল দলে যারা খেলছেন তারা কিন্তু খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে। অনেক ধনী পরিবারের মেয়েরা কিন্তু ফুটবল খেলে না। এখন হয়তো কেউ কেউ খেলছে, কিন্তু আগে খেলত না কিংবা তাদের পরিবার খেলতে দিত না।'

ছবি সাবিনা খাতুনের ফেসবুক থেকে নেওয়া

সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রথম ফোন

সাবিনার বোন সালমার তথ্য অনুযায়ী, সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রথম ফোন তাকেই করেছিলেন। তখন সাবিনা উত্তেজিত ছিলেন, আনন্দে উদ্বেলিত ছিলেন।

সালমা বলেন, 'সবার আগে ও আমাকেই ফোন করেছিল। তখন খুব উত্তেজিত ছিল। ওর কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল খুব আনন্দিত ছিল। আমরাও তাকে বলেছিলাম, আমরা খুব গর্বিত ও আনন্দিত। সাবিনা শুধু আমাদের বোন না- সাতক্ষীরার গর্ব, পুরো জাতির গর্ব, দেশের গর্ব।'

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago