রক্তাক্ত শারদ কবে শারদ সম্প্রীতিতে রূপ নেবে

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ছিল মহালয়া। মহালয়া আসা মানেই দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা শুরু। আমি ছেলেবেলায় মহালয়ার পর থেকে হাতে কড় গুণতাম। আর কতদিন বাকি? একটা দিন বাদ পড়ত আর খুশির রেশ আমায় গ্রাস করত। শুধু আমাকে না হিন্দু ধর্মাবলম্বী সবারই মনে দুর্গাপূজা মানেই বিশেষ উৎসব, যে উৎসবের জন্য আমরা সারাবছর অপেক্ষা করি।

এবার মহালয়ার পর থেকেই ভয়, আতঙ্ক গ্রাস করেছে মনে। এবারও কি গতবারের মতো পণ্ড হবে উৎসব? এবারও কি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ইকবাল এসে হানা দেবে কোনো মণ্ডপে? এবারও কি প্রশাসন শুধু 'দেখবে' আর 'দেখছি' বলে দায় এড়াবে?

একটা রাষ্ট্র চাইলেই ৫ দিনের দুর্গাপূজা নিরাপদ করতে পারে। রাষ্ট্র কি চাইছে? এই ভয় আমার মধ্যে, আমাদের মধ্যে ছিল না। কেন এমন হলো?

শরৎকাল। তৃতীয় ঋতু। আমার প্রিয় ঋতু। শরৎ এলেই মনটা কেমন জানি ঘরে থাকতে চায় না। বাইরে ছুটে যায় বারবার। যেন রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে হয়, 'আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা—নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।।' শরীর, ইন্দ্রিয় সবকিছু ছুটে যায় নবীন গতিতে। মনে হয় কী যেন নেই, কে যেন নেই। নেই বলে যে কিছুই নেই তা নয়। শরৎ যেন আমার মগজে-মননে মাথা চাড়া দিতে থাকে।

মাটির সোঁদা গন্ধ, ধূপের তীব্র ঘ্রাণ খুঁজে বেড়াই। মাঝে মাঝে শিউলি করে গ্রাস। চোখ বন্ধ করলেই যেন নাকে এসে লাগে। শরৎটা কেমন যেন, চট্টোপাধ্যায়ের মতো না হলেও একরোখা। আমার মনের মধ্যে বাজে মন্দিরের ঘণ্টার মতো। আমি শরতে দত্তা না খুঁজলে দত্ত খুঁজে বেড়াই। কাশফুল আর শিউলির আবেশে আমি মন তৈরি করি শুধু শরতের জন্য। আমার ছেলেবেলা যে এইভাবেই তৈরি।

ঢাক বাজবে। মা আসবে। প্রদীপ জ্বলবে। হইচই, আড্ডা আর বাজি পোড়ানোর গন্ধ আরও কত কিছু। ভোরে মাইকে বেজে উঠবে 'আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির…', বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমন দরাজ গলা হরণ করবে মন। সেইসব কি এখনো আছে?

আমি থাকতাম বাণিজ্যিক শহরে। তবে বাণিজ্য নয় সৃজনেই আমার বেড়ে ওঠা। নন্দনকাননে আমরা লালু মজুমদারের বাড়িতে প্রথম প্রতিমা দর্শন করতাম। মাকে দেখেই মন ছুটে যেত বাড়ির পানে। মামার বাড়ি মধুর হাড়ি এইটা বলতে বলতে একরাশ আনন্দ নিয়ে গাড়িতে চড়তাম।

গন্তব্য চট্টগ্রামের বাঁশখালী। বাঁশখালীর গুনাগরীতে নামলেই যেন মনটা শীতল হয়ে যায়। শরতের পেঁজা মেঘ যেন উদাত্তভাবে ডাকছে আমায়। কয়েক যুগের স্মৃতি তো, সহজে যায় না উবে। মায়ের বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত গুনাগরীতেই থাকতাম। আমি বেড়ে উঠি, সাথে বেড়ে ওঠে স্মৃতি। বাড়ন্ত স্মৃতিতে দুর্গাপূজার সেই যে আদল গড়েছে, তা এখনো সজীব।

সময় বদলেছে। বদলে গেছে মানুষের মনন। এখন দুর্গাপূজা মানেই একধরনের ভয়। শঙ্কা কাজ করে মনে। শুধু কি আমার না সবারই? ১৩ অক্টোবর ২০২১। অষ্টমী রূপ নিল বিসর্জনে হোমানলে। কেমন যেন শরীর পুড়ছে। কষ্টটা কোথায় ঠিক দেখাতে পারছি না। কাঁদতেও পারছি না। গলা ধরে আসছে। মনে যে তীব্র কষ্ট!

কুমিল্লায় ঘটে যায় সবচেয়ে বড় অঘটন। মাঝপথে বিসর্জনের জন্য কি দেবীর আগমন হয়েছিল? একটা দেশ, একটা সরকার এইভাবে মন ভেঙে দিলো! প্রশ্রয় দিল উগ্রবাদীদের! কুমিল্লার তাণ্ডব রেখা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে।

সেই পুরোনো স্ক্রিপ্ট, সেই পুরোনো ধরন। সনাতনীদের বুক একের পর এক রক্তাক্ত হচ্ছে। কাশফুলের শুভ্র শারদ মুহূর্তেই রূপ নিল রক্তাক্ত শারদে। এমনকি হওয়ার কথা ছিল? এইসব যে পরিকল্পিত তা কি আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে? সব ধর্মের মানুষই জানেন ১৩ অক্টোবর ২০২১, কুমিল্লার তাণ্ডব পরিকল্পিত।

দুর্গাপূজা যে সংস্কৃতির অংশ, সম্প্রীতির মেলবন্ধন তা যেন মিছে হয়ে গেল মুহূর্তেই। অথচ দুর্গাপূজা মানেই সৌহার্দ্য, ভাতৃত্ব, সম্পর্কের নিবিড় মেলবন্ধন। মনে পড়ল সেই পুরোনো কথা। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বিখ্যাত উর্দু কবি জাভেদ আখতার এক সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার রাজ্যে দাঙ্গা হয়নি কেন? তখন তিনি এককথায় উত্তর দিয়েছিলেন, কিউ কি হুকুমত নেহি চাহতি। অর্থাৎ প্রশাসন চায় না, তাই দাঙ্গা হয় না।

কয়েকটি বাক্যে যেন সব বলে দিলেন। অথচ আমার ছেলেবেলার শারদ ছিল গল্পের মতো, কল্পনার মতো, সম্প্রীতির। এখন কি সবই মিছে? ছেলেবেলার শারদের দৃশ্যপটের দেখা মেলে চলচ্চিত্রে। অবশ্যই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নয়, ভারতের চলচ্চিত্রে। দেখেই যেন মন ভরে যায়, ভক্তি জাগে।

কাঁটাতার আলাদা করেছে বটে, পূজা কি আলাদা হয়েছে? একদিকে বাংলাদেশের দুর্গাপূজায় তাণ্ডব, অপরদিকে কলকাতার দুর্গাপূজায় জাতিসংঘের স্বীকৃতি। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ যেন। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হলেও কলকাতায় দুর্গাপূজা হয় সম্প্রীতির সমাবেশে। দুর্গাপূজাকে ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিলো জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো।

এই উপমহাদেশে দুর্গাপূজার যে আমেজ-আবেশ তা এখন অনুপস্থিত বাংলাদেশে। কলকাতায় অবশ্য এর চিত্র ভিন্ন। মা একেক রূপে সাজেন সেখানে। দুর্গাপূজা মানেই যেন সাজ সাজ রব। বিশাল সমারোহ, বিরাট আয়োজন। পাঁচ থেকে সাত দিনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দেখেই মনে হয় উৎসব।

উৎসব শুধু কলকাতাতেই নয়, উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশে। কলকাতার মাঠ ছাড়িয়ে দেবী এখন পূজিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আড়ম্বর যেন দেখার মতো। যুক্তরাষ্ট্রেও ভক্তদের মনে আসন গেড়েছেন মা দুর্গা। নিউইয়র্কের ডাইভার সিটি প্লাজার জ্যাকসন হাইটসে পাঁচ দিনের পূজার আয়োজন করেছে বাঙ্গালি ক্লাব, ইউএসএ। সর্বজনীন দুর্গোৎসবের দেখা মেলে দেশের বাইরে চোখ দিলে।

দেশের মাটিতে সুষ্ঠুভাবে পূজার আয়োজন শেষ হবে, তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও জ্যাকসন হাইটসে সেই শঙ্কা নেই। শুধু জ্যাকসন হাইটস নয়, কোথাও নেই। এত শঙ্কা, এত উদ্বেগ নিয়ে পূজা উদযাপন কি হয়? আনন্দ কি থাকে? এত মানসিক চাপ নিয়ে কোনো উৎসব উদযাপন সম্ভব? আমার নবীন শিশু কি এইভাবে দুর্গাপূজা দেখবে?

কেন আমরাও বলতে পারি না, সরকার চাইছে না তাই সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে না। কেন জোর গলায় বলতে পারি না এটা বাংলাদেশ, সম্প্রীতির দেশ এখানে সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ। হেলাল হাফিজের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে,

'কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে

ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।'

রক্তাক্ত শারদ থেকে শারদ সম্প্রীতি ফিরে আসবে, সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ হয়ে সম্প্রীতির সমাবেশ ঘটবে সেই দিনের প্রত্যাশায় আমিও স্বপ্নে বিভোর। কবে আসবে সেদিন?

বিনয় দত্ত: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

8h ago