৯ বছর আগে সাগর পাড়ি, থাই কারাগারের ২ বন্দিকে ফেরাতে স্বজনের আকুতি

থাই কারাগারে বন্দি আজিজুল। ছবি: সংগৃহীত

উন্নত জীবনের আশায় প্রায় এক দশক আগে দেশ ছেড়ে যান ৩ বাংলাদেশি। কিন্তু গত ৬ বছর তাদের কোনো খোঁজ পায়নি পরিবারের সদ্যসরা। মাঝে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, দালালের কারসাজিতে তারা মালয়েশিয়া নয়, থাইল্যান্ডে আটক আছেন। তাদের মুক্ত করতে আরও টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সে টাকাও দেওয়া হয়নি এবং এর মাঝে তাদের কোনো খবরও পাওয়া যায়নি।

এরপর ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে একটি গণকবর খুঁজে পাওয়ার সংবাদে পরিবারের সদস্যরা ধরে নেন, ওই ৩ জন মারা গেছেন।

তবে, ৩ বছর আগে অপ্রত্যাশিতভাবে মানবপাচারের শিকার অপর এক ভুক্তভোগী ব্যাংককের একটি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ২টি ছবি। ওই ছবি দেখে বাকি ২ জনের পরিবারের সদস্যদের মনে আবারও আশার সঞ্চার হয়। প্রিয়জনের বেঁচে থাকার প্রমাণ পান তারা।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা গতকাল কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকা আসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়ার জন্য। তাদের আশা, এই চিঠি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে পৌঁছাবে এবং এতে তাদের প্রিয়জনদের দেশে ফিরে আসার পথ সুগম হবে।

ভালো উপার্জন ও পুরো পরিবারের জন্য আরও উন্নত জীবনের আশায় সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে ২০১৩ সালে ওই ৩ ব্যক্তি মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমান।

কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

৯ বছর আগে শেষবারের মতো ভাই আজিজুলের কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন সিদ্দিক। তখন পরিস্থিতি বেশ ভয়ংকর ছিল বলে তিনি জানান।

আজিজুল মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য একটি মাছ ধরার জাহাজে ওঠার কয়েক মাস পর তার সঙ্গে সিদ্দিকের কথা হয়।

তিনি থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গল থেকে ফোন করে জানান, তাকে মানবপাচারকারীরা আটকে রেখেছে। তিনি সিদ্দিককে তাৎক্ষণিক ২ লাখ টাকা পাঠাতে বলেন।

আজিজুল ফোনে তার ভাইকে বলেন, 'দয়া করে দালালের কাছে অন্তত কয়েক হাজার টাকা পাঠাও, না হলে তারা আমাকে মারতেই থাকবে।'

সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে এই তথ্য জানান।

সিদ্দিক মহেশখালীর বাঘারপাড়া অঞ্চল মাছের পোনা ধরে ও লবণের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি তার ভাইয়ের জন্য কিছুই পাঠাতে পারেননি।

সিদ্দিক বলেন, 'আমি আমাদের শেষ ছাগলটি বিক্রি করে তাকে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ২ লাখ টাকা জোগাড় করেছিলাম। বাড়তি টাকা কোথায় পাব?'

নিরুপায় হয়ে তারা আজিজুলের ভাগ্যকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

৯ বছর পর এসে সিদ্দিক জানেন, তার ভাই জীবিত আছেন এবং বাং কোয়াং কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি হাজতে কারাদণ্ড ভোগ করছেন।

সিদ্দিক বলেন, 'আমার ভাইয়ের সঙ্গে কারাগারে ছিলেন এরকম এক ব্যক্তি আমাদের কাছে এসে ২টি ছবি দেখান। একটি ছবিতে ভাইকে একটি টুপি ও কয়েদিদের সবুজ পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। আমার ভাই ওই ব্যক্তিকে তার মুক্তির পর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ও এই ছবিটা দিতে অনুরোধ করেন।'

'আমার মা ছবিটা দেখে অত্যন্ত খুশি হন। তিনি কখনোই আশা হারাননি', যোগ করেন সিদ্দিক।

থাইল্যান্ডের মানবাধিকার সংস্থার সূত্ররা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রতিনিধিদের কাছে নিশ্চিত করেছে, অন্তত ১৭ জন বাংলাদেশি কয়েদি বাং কোয়ান কেন্দ্রীয় কারাগারে জেল খাটছেন এবং ক্লং প্রেম কেন্দ্রীয় কারাগারে আরও ৭ জন বাংলাদেশি রয়েছেন।

সাথনে অবস্থিত ব্যাংককের ইমিগ্র্যান্ট ডিটেনশন কেন্দ্রে আরও ১৮ বাংলাদেশি আটক আছেন।

মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশিদের বৈধ পন্থায় মালয়েশিয়া যাওয়া স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর, অভিবাসী কর্মীদের নৌকার মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছিল। এ সময় অনেকেই নির্যাতিত, বহিষ্কৃত, গণকবরে সমাধিস্থ অথবা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অনেকেই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া গেছেন। আমরা জানি না কতজন নিখোঁজ আছেন। আমাদের দূতাবাসগুলোর উচিত কারাগারে খোঁজ নিয়ে দেখা, কয়জন বাংলাদেশি কয়েদি সেখানে কারাদণ্ড ভোগ করছেন।'

ছবি বহনকারী ব্যক্তিটি মাকসুদ আলীর পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। ব্যাং কোয়ান কারাগারের যে ওয়ার্ডে মাকসুদকে রাখা হয়েছিল, তার ক্রমিক নম্বরটি তিনি তার পরিবারকে জানান। এমনকি, তার কয়েদি নম্বরও জানাতে সক্ষম হন সেই ব্যক্তি।

মাকসুদও তার ভাই নূর কবীরের সঙ্গে সর্বশেষ ২০১৩ সালে কথা বলেন। টেকনাফ থেকে নৌকা করে রওনা হওয়ার ৩ মাস পরে তাদের মধ্যে কথা হয়।

মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের দিনমজুর মাকসুদ ভেবেছিলেন, স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যেতে মাছ ধরার নৌকার যাত্রাই যথেষ্ট। তার ভাই কক্সবাজার শহরে তাকে বিদায় জানান এবং একজন দালাল তাকে টেকনাফে নিয়ে যান, যেখান থেকে তার একটি নৌকায় আরোহণ করার কথা ছিল।

নূর কবীর জানান, 'আমরা জীবিকার জন্য মাছের পোনা ধরি।'

'আমরা মাকসুদকে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য আমাদের সব জমি ও বসতভিটা বিক্রি করে ২ লাখ টাকা জোগার করি', যোগ করেন তিনি।

নূর কবীর আরও বলেন, '৩ মাস পর, একজন দালাল ফোন করেন এবং আমার ভাইয়ের হাতে ফোন দেন। মাকসুদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, সে থাইল্যান্ডে আছে। তারা তার ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং সে জানায়, নিরাপদে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য তার আরও ২ লাখ টাকা প্রয়োজন।'

'সে আমাকে অন্তত ২০ হাজার টাকা পাঠাতে বলে, কিন্তু আমার কাছে কিছুই ছিল না', যোগ করেন নূর কবীর।

কবীরের কাছে প্রয়োজনীয় টাকা ছিল ছিল না এবং এ কারণে তিনি তার ভাইয়ের আর কোনো সংবাদ পাননি। তবে ৩ বছর আগে এক ব্যক্তি তার ভাইয়ের কয়েদি নম্বরসহ তাদের বাসায় আসলে পরিস্থিতি বদলে যায়।

ছবিতে মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের বাসিন্দা মোজাহের মিয়াকেও দেখা যায়। তিনিও একই সময়ে একই পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন।

মোজাহের আলীর স্ত্রী জোহরা খাতুন যখন এই ছবিটা দেখে জানতে পারলেন তার স্বামী বেঁচে আছে, তখন তিনি তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান।

তিনি হোয়ানক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে চিঠি লিখতে রাজি করান। এরপর তিনি কক্সবাজারের উপ-কমিশনারের কাছেও চিঠি পাঠান। পরবর্তীতে কক্সবাজারের সহকারী কমিশনার ও পুলিশের বিশেষ শাখা এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছে।

তবে পরিবারের সদস্যরা জানান, এতে কোনো লাভ হয়নি।

এখন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে কোনো ইতিবাচক ফল আসে কি না, তা দেখার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া তাদের হাতে আর তেমন কোনো বিকল্প নেই।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Made with US cotton? Pay less at US customs

Bangladesh is likely to benefit from reduced US tariffs on garment exports under a new clause that incentivises the use of American materials, potentially enhancing the country’s competitiveness in the US market.

41m ago