১৯৭১ সালে নেরুদার কাছে নোবেল হারিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

নোবেল পুরস্কার যদিও সেরা সাহিত্যিকের একমাত্র মানদণ্ড নয় কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকে পুরস্কারটিকে অনেক মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। অনেক অপরিচিত লেখককে নোবেলের মাধ্যমে যেমন বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করা গেছে, তেমনি বিশ্বসাহিত্যের অনেক রথী-মহারথীকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি নোবেল কমিটি। 

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর অন্তত ডজনখানেক কবি-সাহিত্যিক নোবেল পাওয়ার যোগ্য হলেও কেউই পাননি। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭১ সালে প্রায় নোবেল জয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু লাতিন আমেরিকা তথা বিশ্ব কবিতার বরপুত্র পাবলো নেরুদা সেবার নোবেল বাগিয়ে নিয়েছিলেন।

নোবেল পুরষ্কার প্রদান কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী কোন শাখায় নোবেল মনোনীতদের নাম পরবর্তী ৫০ বছর কেউ প্রকাশ করতে পারবেননা। ১৯৭১ সালে বিভিন্ন শাখায় মনোনীতদের নাম পাওয়া যাচ্ছে নোবেল প্রাইজ ডট ওআরজি ওয়েবসাইটে। সাহিত্যে মনোনীতদের তালিকায় দেখা গেছে, ওই বছর নমিনেশন পাওয়া ১৩৭ জনের সঙ্গে একেবারে শুরুর দিকেই রয়েছেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। তার নামে নমিনেশন প্রস্তাব তুলেছিলেন ওই সময়ে সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারি কৃষ্ণ কৃপালিনী। কৃষ্ণ কৃপালিনী নিজেও একজন লেখক, রাজনীতিক এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৬৯ সালে স্বদেশের পদ্ম ভূষণ পদক পান।  

যে বছর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল সেই ১৯৭১ সালেরই ১৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় লেখকের। নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু কাউকে মরণোত্তর নোবেল দেওয়া হয় না, তাই আর বিবেচিত হয়নি। প্রসঙ্গত, এতবছর ধরে শুধুই নোবেলজয়ীদের নাম প্রকাশ করত সুইডিশ কমিটি।  এবছর পুরনো আর্কাইভ প্রকাশ করে কমিটি। জনসমক্ষে প্রথমবারের মতো আসে মনোনীত ব্যক্তিদের নাম। এই আবহে মনোনয়নের ৫১ বছর পর জানা গেল যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।সেবার তারাশঙ্করের সঙ্গে বিশ্ব সাহিত্যের আরও যেসব দিকপাল মনোনয়ন পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, হোর্হে লুই বোর্হেস, এজরা পাউন্ড, ভ্লাদিমির নভোকভ, আর্থার মিলার, অদ্রেঁ মারলো, ফিলিপ লারকিন, গুন্টার গ্রাস, উইলিয়াম গোল্ডিং ও সল বেলো প্রমুখ।

নোবেল কমিটি যেহেতু মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ শুরু করেছে তাতে হয়তো সামনের বছরগুলোতে আরও কিছু ব্যক্তিত্বের নাম দেখা যাবে। বাংলা সাহিত্যে কেন নোবেল একটিতে আটকে রয়েছে এ নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মন্তব্য পাওয়া যায়। একদল মনে করেন, বাংলা সাহিত্যের সেরা রত্নগুলো ইংরেজি বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়নি। তাই নোবেল কমিটিতে যে বুড়ো লোকজন থাকেন তাদের কাছে পৌছায় না। আবার আরেকদল মনে করেন, আধুনিক বাংলা সাহিত্য ইংরেজি সাহিত্য বা ইউরোপীয় কোন সাহিত্যেরই কপি-পেস্ট। তা অনুবাদ করলে হয়তো ইউরোপীয় সাহিত্যের তৃতীয় শ্রেণীর কোন কার্বনকপি পাওয়া যাবে। 

দুই এক্সট্রিম মতামতকে আমলে নিয়ে এগুলে বরং আমাদের সম্ভাবনা রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আল মাহমুদের মতো চরিত্র আছেন বাংলা সাহিত্যে। তারাশঙ্করের পাশাপাশি এ নামগুলোও উঠে আসতে পারে নোবেল মনোনীতদের তালিকায়। 

১৯৭১ সালে নোবেলের জন্য মনোনীত হওয়া তারাশঙ্কর ৬৫টি উপন্যাস, ১২টি নাটক ও ৫৩টি গল্প লিখেছেন। রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ, পদ্মশ্রী ও পদ্ম ভূষণ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে তারাশঙ্কর নোবেল জিতলে ভারতবর্ষে সাহিত্যে দ্বিতীয় নোবেলটিও উঠত এক বাঙালির হাতে।

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদারবংশে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে তিনি মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন। মহাত্মা গান্ধীর  অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন। ফলে তার শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। পরে তিনি পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন। কারামুক্তির পর কিছুকাল গ্রামে কাটিয়ে ১৯৪০ সালে তিনি স্থায়িভাবে কলকাতার বাসিন্দা হন এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।

কালিকলম, বঙ্গশ্রী,  শনিবারের চিঠি,  প্রবাসী, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তারাশঙ্করের লেখা প্রকাশিত হয়। তবে রাজনীতি থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান পরিচয়। বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি ছিল তার উপন্যাসের মূল সুর। তারাশঙ্করের রচনার আর একটি বিশেষ দিক হলো-তিনি পরম যত্নের সঙ্গে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। শরত্চন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যারা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁদের একজন। তারাশঙ্কর প্রায় দুশ গ্রন্থ রচনা করেন। তার দুই পুরুষ, কালিন্দী, আরোগ্য নিকেতন ও জলসাঘর অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। 

নোবেল পুরস্কার নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক ও গৌরবের। কিছু ব্যক্তিত্বকে তাদের কর্মগুণে নোবেল কমিটি পুরস্কৃত করতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করে। জর্জ বার্নাড শ, বার্ট্রান্ড রাসেল, আলবার্ট আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা এদেরই কয়েকজন। আবার পুরস্কার পেয়েও গ্রহণ করেনি এমন উদাহরণও রয়েছে অনেক। সাহিত্যে অনেককে নোবেল দিয়ে ধন্য হয়েছে নোবেল কমিটি। আবার অনেককে দেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। 

নোবেলবঞ্চিত মহান লেখক বা বড় সাহিত্যিকের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে লিও টলস্টয়ের নাম। ১৯০১ সালে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন লিও টলস্টয়। কিন্তু বিচারকরা তার নৈরাজ্যবাদ ও অদ্ভুত ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে পুরস্কারের জন্য অযোগ্য মনে করেন। ১৯০২ সালে আবার মনোনীত হন। সেবারও প্রত্যাখ্যাত হন। টলস্টয় এতে কিছু মনে করেননি। তার মতে, 'টাকা-পয়সার লেনদেন একটা কঠিন ব্যাপার। পুরস্কার না পেয়ে ভালো হয়েছে। এটা কেমনে খরচ করতাম? টাকা-পয়সা অনেক দরকারি ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটাকে আমি সব মন্দের উৎস মনে করি।' টলস্টয় কিছু মনে না করলেও, তার নাম সেখানে না থাকায় নোবেল পুরস্কারকে একটু দীন মনে হয়। 'ওয়ার অ্যান্ড পিস', 'আনা কারেনিনা' বিশ্বসাহিত্যের সেরা দুটি উপন্যাস। যেকোনো একটিই পুরস্কার জেতার জন্য যথেষ্ট ছিল। না পাওয়ার পেছনে যেসব কারণ বলা হয় তার একটি হচ্ছে, তার লেখা আদর্শবাদী ছিল না, ছিল বাস্তববাদী। আরেকটি কারণ এবং সবচেয়ে জোরালো কারণ হতে পারে সেটা রাশিয়া ও সুইডেনের মধ্যকার অনেক পুরনো দ্বন্দ্ব। 

শেক্সপিয়রের পর নাটকের জগতে যাদের নাম সবচেয়ে জোরেশোরে আলোচিত, হেনরিক ইবসেন তাদের মধ্যে অন্যতম। নরওয়ের সেরা লেখক ও আধুনিক নাট্যেতিহাসের অন্যতম নক্ষত্র ইবসেনের অন্যতম সৃষ্টি 'এ ডলস হাউস', 'হেড্ডা গেবলার', 'পিলারস অব সোসাইটি' প্রভৃতি। বাস্তববাদী নাট্যকার ইবসেনকে নোবেল না দেওয়ার পক্ষে যে যুক্তি দেখানো হয়, তার লেখা আদর্শবাদী নয়।

বিশ্বসাহিত্যের সেরা পাঁচজন ঔপন্যাসিকের অন্যতম জেমস জয়েসের নাম পুরস্কারের খাতায় না থাকায় নোবেল পুরস্কারকে অত্যন্ত গরিব দেখাচ্ছে। 'ইউলিসিস', 'ফিনেগেনস ওয়েক', 'এ' পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট আ্য্যজ এ ইয়াং ম্যান' ও ছোটগল্প সংগ্রহ 'দি ডাবলিনার্স' আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সাহিত্যের সংযোগ সড়ক স্বরূপ। নতুন ধারা ও নতুন বর্ণনারীতির (বিশেষ করে চৈতন্য প্রবাহ রীতি) নির্মাণে তিনি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। খুব মজার ব্যাপার হলো জেমস জয়েস প্রভাবিত সাহিত্যিক স্যামুয়েল ব্যাকেট  ও সল বেলো নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। জয়েসকে নোবেল দিয়ে নোবেল কমিটি নিজেদের গৌরবান্বিত করতে পারত।

বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্ট কেন নোবেল পেলেন না এটাও একটা দুর্বোধ্য বিষয়। কবিতার জন্য চারবার পুলিৎজার বিজয়ী এবং ৪০টিরও বেশি সম্মাননা ডক্টরেটধারীর (অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, প্রিন্সটন, হার্ভার্ডসহ প্রায় সব প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যুক্ত) নোবেল অপ্রাপ্তি একটু বেখাপ্পা দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা জোরজবরদস্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও রবার্ট ফ্রস্ট বিশ্বজুড়ে পাঠকের মন জয় করেছেন তার অসাধারণ ও কালজয়ী কবিতার মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনায়ক সবার প্রিয় এ কবির একটা কবিতার লাইন 'অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ' সব কবিতা পাঠকের জানা। মৃত্যুর ২০ বছর আগেই চতুর্থবারের মতো পুলিৎজার জেতেন। নোবেল কমিটি কি ওই ২০ বছরেও তার নাম শোনেনি?

নজরুল-জীবনানন্দের (তারা দুজনও না পাওয়ার দলে!) জন্মবছর জন্ম নেওয়া ভ্লাদিমির নবোকভ রুশ ভাষায় কিছু কবিতা লিখলেও গত শতকের সেরা ১০০ ঔপন্যাসিকের সব তালিকাতেই তার নাম একেবারে ওপরের দিকেই থাকে। টলস্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কির পর সবচেয়ে বড় রাশিয়ান সাহিত্যিকের লেখালেখির প্রধান ভাষা ছিল ইংরেজি। তার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হচ্ছে 'ললিতা', হলিউডে যাকে নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। অসংখ্য ছোটগল্প, কিছু নাটক ও অনেকগুলো উপন্যাসের লেখক এ মহান সাহিত্যিকের আরেকটি বিখ্যাত সৃষ্টি 'পেইল ফায়ার' (Pale Fire)।

এই ছাড়া আরও কয়েকজন সাহিত্যিকের নাম বলি, যাদের কপালে নোবেল না জুটলেও জুটেছে বিশ্বজোড়া মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান। মার্ক টোয়েন, ম্যাক্সিম গোর্কি, থমাস হার্ডি, জন আপডাইক, আন্তন চেখভ, বারটল্ট ব্রেখ্ট, অগাস্ট স্ট্রিনবার্গ, ফ্রান্জ কাফকা, জোসেফ কনরাড, গার্সিয়া লোরকা, ডি এইচ লরেন্স, হেনরি জেমস, হোর্হে লুই বোর্হেসদের নাম এই তালিকাটাকে কেবল দীর্ঘই করবে। নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে অনেকগুলো সমালোচনার একটি হচ্ছে তারা 'ইউরোসেন্ট্রিক' বা ইউরোপকেন্দ্রিক। যাদের কথা বলা হলো নোবেল না হলেও তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। তাদের গৌরবের কোনো ঘাটতি হয় না; বরং নোবেল পুরস্কারটাই রিক্ত মনে হচ্ছে!

Comments

The Daily Star  | English

Stocks fall on poor performance of large companies

Indexes of the stock market in Bangladesh declined yesterday on rising the day before, largely due to the poor performance of Islami Bank Bangladesh along with the large-cap and blue-chip shares amid sales pressures..Large-cap refers to shares which account for large amounts in market capi

2h ago