বাড়তে পারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ
পাওয়ার গ্রিড আপগ্রেডে ধীরগতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ঋণ পরিশোধের পদ্ধতিতে সম্ভাব্য পরিবর্তন এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে।
১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকার এই প্ল্যান্টে ২টি ইউনিট রয়েছে, যার প্রতিটির ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। চুক্তি অনুসারে, এই খরচের টাকার মধ্যে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার) ঋণ হিসেবে দেবে রাশিয়া।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত হবে।
তবে প্ল্যান্টটির বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে আরও দেরি হতে পারে। কেননা, আগামী বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার জন্য নির্ধারিত পাওয়ার ইভাকুয়েশন ফ্যাসিলিটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫ বছরে মাত্র ২৭ শতাংশ আর্থিক ও ৪৫ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি দেখা গেছে।
সম্প্রতি প্লান্ট সাইটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর জানান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন সুবিধার আওতায় পাওয়ার গ্রিড আপগ্রেড না করা পর্যন্ত তারা প্ল্যান্টটি চালাতে পারবেন না।
তিনি বলেন, 'একবার এই প্ল্যান্টে পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার শুরু করলে, আমরা উৎপাদন বন্ধ করতে পারব না।'
১০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট থেকে ৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকা অর্থায়নে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) অধীনে অবকাঠামো উন্নয়ন সুবিধার কাজ শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৯ অক্টোবর দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্ল্যান্টের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ চুল্লির উদ্বোধন করেন।
দ্বিতীয় চুল্লি স্থাপনের একদিন আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত প্ল্যান্টের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে না।
নির্ধারিত সময়ে ট্রান্সমিশন লাইন প্রস্তুত হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এর উত্তর আমার কাছে নেই। এর দায়িত্বে থাকা পিজিসিবি সময়সীমা অনুযায়ী গ্রিড প্রস্তুতের চেষ্টা করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সময়মতো গ্রিড প্রস্তুত না হলে দেশের জন্য তা ক্ষতির কারণ হবে।'
ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পর মস্কো গত জুনে ঢাকায় একটি প্রস্তাব পাঠায়, মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রুবলে ঋণ পরিশোধের জন্য। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুসারে, এর ফলে ঋণের অর্থ পরিশোধে খরচ বাড়বে।
২০১৬ সালের ১৬ জুলাই সই করা চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের এই ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল ডলারে।
গত আগস্টে মস্কো ঢাকায় একটি নতুন প্রস্তাব পাঠায় চুক্তিটি সংশোধন করতে এবং ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থপ্রদানের পদ্ধতি, পেমেন্ট গেটওয়ে ও মুদ্রা পরিবর্তন করতে।
রাশিয়া বাংলাদেশকে চীনের একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছে। সেখানে, ডলার প্রথমে ইউয়ানে এবং তারপর রুবলে রূপান্তরিত হবে।
গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ইউক্রেনের রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে সুইফট থেকে বহিষ্কার করা হয়। উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত সুইফটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে আর্থিক লেনদেন করা হয়।
রাশিয়ার এই প্রস্তাবের বিষয়ে ইয়াফেশ ওসমান বলেন, 'আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারি না। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।'
তিনি বলেন, 'তবে, আমি বলতে পারি যে বাংলাদেশ ও রাশিয়া উভয়েই বিষয়টি সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করছে।'
একটি প্রশ্নের জবাবে ইয়াফেশ ওসমান দাবি করেছেন, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, সব জিনিস ইতোমধ্যেই ঠিক করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক জানান, প্ল্যান্টের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার ২ বছর পর ঋণ পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, '(বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি) মন্ত্রণালয়ের একটি দল রাশিয়ার নতুন প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে।'
ইআরডি কর্মকর্তারা বলেছেন, অর্থপ্রদান পদ্ধতিতে পরিবর্তনের অর্থ বাংলাদেশকে একাধিকবার মুদ্রা পরিবর্তন করতে হবে, যা ঋণের ব্যয় বাড়াবে এবং সেইসঙ্গে বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে ঝুঁকি বাড়াবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'বাংলাদেশ এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য দায়ী নয়। তাই আমাদের প্রচেষ্টা হবে এটা নিশ্চিত করা, যেন আমাদের কোনো অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা বহন করতে না হয়।'
যখন ঋণ চুক্তি সই হয়, তখন বিনিময় হার ছিল ১ ডলারের বিপরীতে ৮৫ টাকার নিচে। এখন এটি ১০৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্ল্যান্টটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার ২ বছর পর বাংলাদেশ যখন ঋণ পরিশোধ শুরু করবে, তখন টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকলে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হবে।
বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, রাশিয়ার ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে চুক্তি সইয়ের সময় বিনিময় হারের কারণে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
সরকার পাবনায় ১ হাজার ৬২ একর জমির ওপর এই মেগা প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ করার জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলোর একটি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ ২০১৭ সালের নভেম্বরে শুরু হয়। এর কাজ শেষ হলে ভারত ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ তৃতীয় এশিয়ান দেশ হিসেবে পরমাণু শক্তি ব্যবহারকারী হয়ে উঠবে।
Comments