‘আমি বাঙালি, এই পরিচয়টাই বেশি তৃপ্তি দেয়’

আসাদুজ্জামান নূর
আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: শেখ মেহেদী মোরশেদ/স্টার

বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। তার অভিনয় এ দেশের টেলিভিশন নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। মঞ্চেও তার অবদান অপরিসীম। 

কোথাও কেউ নাটকের বাকের ভাই, অয়োময়ের মির্জা, নান্দাইলের ইউনুস চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি।

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সাড়া জাগানো অনেক নাটকে তার অনবদ্য অভিনয় মঞ্চপ্রেমীরা মনে রাখবেন দীর্ঘকাল।

স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান নূর একইসঙ্গে একজন রাজনীতিবিদ এবং সংসদ সদস্য।

৩১ অক্টোবর তার জন্মদিন। ৭৬ বছর শেষ করে ৭৭ বছরে পা দিচ্ছেন তিনি।

গত ২৭ অক্টোবর বেইলি রোডের বাসায় তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে দিয়েছেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকার।

তিন দশক আগে প্রচারিত 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি এখনো জনপ্রিয়। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

এটি আমিও মাঝে মাঝে ভাবি। আমার কাছেও অবাক লাগে। আবার এক ধরনের ভালো লাগাও কাজ করে ভেতরে। নতুন প্রজন্মের কাছেও 'কোথাও কেউ নেই' নাটকটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, সেইসঙ্গে বাকের চরিত্রটিও। আমাকে তারা হয়তো অতটা চেনে না। কিন্তু ওই নাটকের সংলাপ ধরে ধরে বলতে পারে তারা। এটা আমাকে অভিভূত করে।

সত্যি কথা বলতে সেই সময় নাটকটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, যা বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। নাটকটি  দেখার জন্য রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। এই নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল হয়েছিল, বাকের ভাইয়ের যেন ফাঁসি না হয়।

শেষ পর্ব প্রচার হওয়ার দিনটির কথা মনে আছে?

মনে আছে। তখন আমি ইস্কাটনের একটি ভাড়া বাসায় থাকি। আমার সন্তানরা তখন ছোট। আমার মা বেঁচেছিলেন,। শেষ পর্ব প্রচার হওয়ার দিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তবে, ফাঁসির দৃশ্য দেখবেন না বলে আগে আগে আমার মা রুম থেকে চলে গিয়েছিলেন। মা নিতে পারছিলেন না। মাকে বুঝিয়েও লাভ হয়নি। মা দৃশ্যটি সহ্য করতে পারবেন না বলেই এমনটি করেছিলেন।

ওই রাতে আমার বাসায় একজন ভদ্রলোক তার শিশুপুত্রকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভদ্রলোকের সন্তান বাকের ভাইয়ের ফাঁসি মানতে পারেননি। খুব কান্নাকাটি করেছে। আমাকে বাড়ির কেয়ারটেকার খবর দিলে তার সঙ্গে দেখা করি। ভদ্রলোক আমাকে বলেন, আমার ছেলে খুব কষ্ট পেয়েছে। অনেক কান্নাকাটি করছে। তারপর আমি শিশুটিকে আদর করি এবং বুঝিয়ে বলি ওটা অভিনয়, বাস্তবের আমি তোমার সামনে।

আরও অনেক ঘটনা আছে 'কোথাও কেউ নেই' নাটকটি নিয়ে। আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে সেসব ঘটনা।

আপনার সবচেয়ে প্রিয় নাটকের নাম জানতে চাই?

একটি নাটকের কথা যদি বলি, তাহলে 'অয়োময়' নাটকের কথাই বলব। এই নাটকের মির্জা চরিত্রটি আমার খুব পছন্দের, খুব প্রিয়। আসলে প্রতিটি কাজই প্রিয়। কিন্তু কিছু কিছু কাজ অতিপ্রিয়। যেমন, অয়োময় এবং মির্জা চরিত্রটি।

ছেলেবেলায় কতটা দুরন্ত ছিলেন?

সত্যি কথা বলতে ছেলেবেলায় ঘরমুখো কখনোই ছিলাম না আমি। স্কুল থেকে এসেই বাইরে যাওয়া, খেলতে যাওয়া। ফুটবল থেকে শুরু করে সবরকম খেলাই খেলতাম। মনে পড়ে, বৃষ্টির দিনে হইচই করে ভিজতাম। আবার শীতের দিনে পিঠা খাওয়ার দিনগুলো বড়ই মধুর ছিল। ছেলেবেলার কথা কখনো ভোলা যায় না। সারাজীবন মনে থাকে।

স্কুল জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

যোগাযোগ আছে। আমি নিয়মিত এলাকায় যাই। কয়েকবছর আগে  আমি উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমার এলাকায় স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হব। তারপর ১৩ জন একত্রিত হতে পেরেছিলাম। কেউ দেশের বাইরে আছেন। কেউ মারা গেছেন। কেউ ব্যস্ত ছিলেন। এই উদ্যোগটি আবারও নেবো। খুব ভালো একটা সময় আমরা কাটিয়েছি।

আবৃওি শিল্পী হিসেবেও আপনি খ্যাতিমান। কবিতার প্রেমে পড়েন কবে?

স্কুল জীবনে। আমার বাবা ও মা দুজনই শিক্ষক ছিলেন। বাবা শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতা পড়তেন। বই পড়তেন খুব। তাকে দেখে দেখে আমিও কবিতা পড়া শুরু করি। কবিতাকে ভালোবেসে ফেলি। সেই যে কবিতার প্রেমে পড়লাম আর ছাড়িনি। এখনো কবিতা পড়ি।

সফল অভিনয়শিল্পী, সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনার জীবনে স্ত্রীর ভূমিকা কতটুকু?

অনেকখানি। আমার স্ত্রী একজন ডাক্তার। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। সারাজীবন অভিনয় নিয়ে থেকেছি। অভিনয়, সাংস্কৃতিক সংগঠন, আবৃত্তি, মঞ্চ নিয়ে থাকতে হয়েছে। আমার স্ত্রী সংসার সামলেছেন। তার একান্ত সহযোগিতা ছাড়া অভিনয়ে, সংগঠনে, মঞ্চে বা রাজনীতিতে সময় দেওয়া কঠিন হতো।

৭৬ বছর শেষ করে ৭৭ বছরে পা দিচ্ছেন। জীবনকে কীভাবে দেখছেন?

জীবন মানে আমি বুঝি কর্ম। একেক মানুষ একেকরকম কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন। কেউ কবিতা লিখেন, কেউ কারখানায় কাজ করেন, কেউ জমি চাষ করেন, কেউবা ছবি আঁকেন। আমি অভিনেতা হয়েছি। অভিনয় করেছি। 

দিন শেষে জীবন খুবই আনন্দময়। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি, ছেলের বউ, মেয়ের জামাইসহ সবাইকে নিয়ে ভালো আছি। বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এখন সব আনন্দের মূলে নাতনি। তাকে নিয়ে অনেক আনন্দে সময় কাটে।

রবীন্দ্রনাথের গান কতটা প্রভাবিত করে?

রবীন্দ্র সংগীত আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মন খারাপ করলেও রবীন্দ্রনাথের গান শুনি, মন ভালো থাকলেও শুনি। অবশ্য যে কোনো গানই আমাকে টানে। ক্লাসিক্যালও টানে, পালাগানও টানে। 
প্রতি বছর সংসদ সদস্য মমতাজের এলাকায় যাই একটা মেলায়। সেখানে গিয়ে পালাগান শুনি। নতুনদের গানও শুনি। গান আমার খুব প্রিয়।

কী ধরনের বই পড়তে ভালোবাসেন?

গল্প, উপন্যাস ও কবিতা তো আমাকে টানেই, পাশাপাশি স্মৃতিকথা, ইতিহাসের বই, রাজনৈতিক বইও টানে। বঙ্গবন্ধুর ওপর যে কোনো লেখা খুব টানে। প্রতি রাতে চেষ্টা করি ১০ পৃষ্ঠা হলেও পড়তে। পড়া ছাড়া একটি রাতও কাটে না।

বাংলাদেশের খুবই জনপ্রিয় একজন মানুষ আপনি। খ্যাতিটাকে কি কখনো বিড়ম্বনা হিসেবে দেখেন?

না, এটা ভালোবাসা। জনপ্রিয়তার জন্য চাইলেও সব জায়গায় যেতে পারি না। সবখানে ইচ্ছেমতো ঘোরাও যায় না। কেউ সেলফি তুলতে চান, কেউ আবার কথা বলতে চান। কিন্ত এটার সঙ্গে ভালোলাগাও আছে।

কোন পরিচয়টা দিতে বেশি খুশি হন?

আমি বাঙালি, বাঙালি পরিচয়ে বেঁচে আছি। বাঙালি পরিচয়ে শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে চাই। বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে যাইনি। এ দেশের জল, বাতাস, মাটি, মাটির ঘ্রাণ সব আমার প্রিয়। বাঙালি পরিচয়টাই আমাকে বেশি তৃপ্তি দেয় ।

এছাড়া আমি বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশ হতো না, স্বাধীনতা পেতাম না। আমি বঙ্গবন্ধুর গড়া দলের একজন রাজনৈতিক কর্মী, এই পরিচয়ও ভালো লাগে। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি, এই পরিচয়ও ভালো লাগে।

জীবনে কোনো আফসোস আছে কি?

না, নেই। তবে, মাঝে মাঝে ভাবি যে শুধু যদি অভিনয় করে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো। শুধুই যদি অভিনয় করতে পারতাম!

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

4h ago