'কাজলা দিদি' প্রসঙ্গে যতীন্দ্রমোহন বাগচী

আবুল মনসুর আহমদ যেমন 'আদুভাই' গল্পের মাধ্যমে বহুল পাঠকের কাছে পরিচিত, অন্যদিকে 'কাজলা দিদি' কবিতার অন্তরালে পড়েছেন প্রখ্যাত কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী। ব্যক্তিমানবের চেয়ে সৃষ্টিকর্মের পরিচয়টাই মুখ্য হয়েছে এমন নজির বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। এক্ষেত্রে 'কবিতা মুকুল' কাব্যের কবি কুসুমকুমারী দাশের 'আদর্শ ছেলে' কবিতাটিও স্মরণ করা যেতে পারে।

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা- রেখা, অপরাজিতা, মহাভারতী প্রভৃতি গ্রন্থ সাহিত্য-সমঝদারের নিকট সমাদৃত ; কিন্তু জনসাধারণের কাছে 'কাজলা দিদি' খুবই পরিচিত। কাজলা দিদি চরিত্রটি এখন আর নিছক বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়; কেননা কাজলা দিদি নামটি কবিতার পাশাপাশি গানেও সমানতালে শোনা যায়। তদুপরি আমাদের প্রাত্যহিক কথায় এবং ছবি-নাটকেও কাজলা দিদি প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে। কাজলা দিদি কবিতায় বাঙালি জীবনের সুখদুঃখ ও চিরায়ত বাংলার পল্লি-প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনায় যতীন্দ্রমোহন বাগচী আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কবিতাটির প্রথম শব্দযুগল 'বাঁশবাগান' প্রকৃতির উপকরণ দিয়ে শুরু হয়েছে। কবিতাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের অন্তরে দোলা দেয়- পাঠককে ভাবায়, কাঁদায়। বিশেষত প্রথম দুচরণ আজও মানুষের অন্তরে মিশে আছে :

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই 
মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই? 

এই আবেদন কি কখনও মুছবার। কাগজ থেকে মুছে গেলেও মানুষের অন্তর থেকে হারাতে পারে না। শিশুটির বড়ো দিদির নাম কাজলা। যখন প্রকৃতিতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে, আকাশে চাঁদ উঠে তখন শিশুটি দিদির কাছে শোলক (শ্লোক) শুনত। একসঙ্গে খাবার খেতো-গল্প করতো। পুতুলের বিয়ে দিয়ে দিতো। অর্থাৎ কাজলা দিদি ছিল শিশুটির সারাক্ষণের সাথী। কিন্তু সহসা দিদিকে কাছে না পেয়ে সে মাকে বার বার শুধায়- দিদি কই গেছে, কবে আসবে? মা এই জটিল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন। 'কবর' কবিতায় যেমন বৃদ্ধ দাদু নাতনিকে বলেছিলেন :

তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!

বৃদ্ধ দাদুর সঙ্গে কাজলা দিদির মায়ের সাযুজ্য লক্ষণীয়। মায়ের চাপাকান্নার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে অপত্য স্নেহ। কাজলা দিদি যে চিরদিনের জন্য চলে গেছে শিশুটি তা জানে না, বুঝে না। মৃত্যু সম্পর্কে তখনও তার কোনো ধারণা হয়নি। সে ভাবছে কাজলা দিদি আবার আসবে। তাই আমরা দেখি:

'ভুঁইচাঁপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল, 
মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল ; 
ডালিম গাছের ডালের ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
দিস না তারে উড়িয়ে মা গো, ছিঁড়তে গিয়ে ফল ;
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবে কী মা বল!'

শিশুটি তার দিদিকে খুবই ভালোবাসত। দিদিকে কাছে না পেয়ে তার সমস্ত আনন্দই যেন মাটি হয়ে যায়। এখন বলা যায় তামাম মনুষ্যজাতির ভালোবাসার মূর্তপ্রতীক কাজলা দিদি। যতীন্দ্রমোহন বাগচী যেন আমাদের সবার অন্তরের আবেগকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই দীর্ঘকাল কাজলা দিদি জনপ্রিয় জনসাধারণের কাছে। বছরের পর বছর যাচ্ছে কাজলা দিদির আবেদন বাড়ছে। কবিতার চরিত্রটি যেন আমাদের আঙিনায় বিদ্যমান। উৎসুক শিশুটির প্রশ্নের মাধ্যমে যেমন কবিতাটি শুরু হয়েছে তেমনি সমাপ্তিও ঘটেছে ঔৎসুক্য প্রশ্নের মাধ্যমেই। রাত হলো যে, মাগো আমার কাজলা দিদি কই? এর উত্তর কোথাও নেই! আমাদের বিশ্বাস, যতদিন সাহিত্যের মর্যাদা থাকবে ততদিন কাজলা দিদি কবিতাটি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন থাকবে।

কবির 'অন্ধবধূ' কবিতাটি পাঠ্যবইয়ে থাকার দরুন শিক্ষার্থীদের নিকট পরিচিত ; কিন্তু 'কাজলা দিদি'র তুমুল জনপ্রিয়তার কাছে অন্যান্য সৃষ্টি ম্রিয়মাণ মনে হয়। এ ধরনের রচনার জন্যই পূর্বাপর জনগণের কাছে সাহিত্য এতো আদরণীয়। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, কাজলা দিদি কবিতার কবির নাম অনেকেই বলতে পারে না।

মানুষ যেমন সন্তানকে অপত্য স্নেহে লালন করেন তেমনি কবি-সাহিত্যিকরাও স্বীয় সৃষ্টিকর্মকে অপত্য স্নেহ করে থাকেন। সন্তান সুখে-শান্তিতে থাকলে মা-বাবা মর্ত্যলোকেই স্বর্গীয় সুখ অনুভব করেন; অপরদিকে কবির সৃষ্টিকর্ম যদি মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় তবে কবি-শিল্পীরাও মনতুষ্ট হন নিশ্চয়। নিজের নাম অন্যের কানে ধ্বনিত হলে শিল্পীরা গৌরবান্বিত হন। প্রসঙ্গত মাইকেল মধুসূদন দত্ত  বলছেন,  রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।  সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ, মধুহীন করো না গো তব।

এমন ভাবনা কবিদের। তাই সৃষ্টি দেখে বিমোহিত হওয়ার পাশাপাশি স্রষ্টাকেও জানতে হবে। শিকড় না থাকলে বিশাল মহীরুহ মাটিতে দাঁড়াতে পারে না। এখানে শিল্পীর পরিচর্যা করা মানে শিল্পের পাশাপাশি শিল্পীর নামটাও জানা অপরিহার্য। শিল্পই শিল্পীর সম্পদ। শিল্প থেকে শিল্পীকে আলাদা করা যায় না। হয়তো নিথর দেহ সৃষ্টিকর্মে আমরা দেখতে পাই না ; কিন্তু গভীরভাবে উপলব্ধি করলে অনুধাবন করতে অসুবিধা হবে না যে, শিল্পীর অন্তর পড়ে থাকে শিল্পে অর্থাৎ শিল্প ও শিল্পী এক অভিন্ন সত্তা। বাহ্যজগতে সৃষ্টি দেখেও আমরা স্রষ্টাকে ভুলে যেতে বসেছি। শিল্পের জগতেও তাই।

'কাজলা দিদি' মানুষের অন্তরে বিদ্যমান কিন্তু যতীন্দ্রমোহন বাগচী তদর্থে অনুপস্থিত। শিক্ষিত সমাজকে আরও কদর করতে হবে শিল্পী ও শিল্পের। সাহিত্যের কেবল রুই, কাতলা, বোয়ালের পাশাপাশি টেংরা, পুঁটির গুরুত্বও অনুধাবন করা চাই। সাহিত্যের আড্ডায়, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়, পাঠচক্রে বিষয়গুলো মনে রাখা জরুরি।

Comments

The Daily Star  | English
IMF sets new loan conditions

Bangladesh needs more time for fully flexible exchange rate, says IMF

Bangladesh is currently going through a transition towards a fully flexible exchange rate regime, and the process may take time, said the International Monetary Fund (IMF).

9h ago