সাতকরা: মেঘালয়-আসাম থেকে আমদানি, ‘সিলেটি’ নামে রপ্তানি

সাতকরা
সিলেটের বাজারে সাতকরা। ছবি: দ্বোহা চৌধুরী/স্টার

সিলেট ভ্রমণের সময় প্রায় সব বাজারেই হলুদ রঙের লেবু জাতীয় গোলাকার ফলটি সাধারণত নজর কাড়ে পর্যটকদের।

এটি সাতকরা। এই লেবু-জাতীয় ফল বৃহত্তর সিলেট, ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় ফলে।

সাতকরা সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ফল। এর খোসা মাংস, বড় মাছ বা ডাল রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এর খোসা একটু টক কিন্তু সুগন্ধি। এটি রান্নায় এনে দেয় ভিন্ন স্বাদ।

শুধু রান্নায় নয়, সাতকরার খোসা দিয়ে আচারও করা হয়। সিলেটের সাতকরার আচারের চাহিদা আছে সারাদেশে।

বহু বছর ধরেই সিলেট, আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ি ও সমতলের মানুষের কাছে সাতকরার ব্যাপক চাহিদা। এই ফলের জনপ্রিয়তা এতই ব্যাপক যে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় 'সাতকরাকান্দি' নামে গ্রাম আছে।

সাতকরার চাহিদা দীর্ঘকাল নির্দিষ্ট এ অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন দেশের অন্যান্য স্থানেও এর চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ থেকে সাতকরা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ব্যাপকহারে রপ্তানি হয়।

এত চাহিদা সত্ত্বেও সিলেট অঞ্চলে সাতকরার উৎপাদন প্রায় শূন্যের কোটায়। এমনকি, সাতকরাকান্দি গ্রামেও এখন হাতেগোনা কয়েকটি সাতকরা গাছ আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সাতকরা
সিলেটের জৈন্তাপুরে সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রে সাতকরার গবেষণামূলক চাষ। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

দেশে উৎপাদন কম হওয়ায় এর চাহিদা এখন আসাম ও মেঘালয় থেকে আসা সাতকরার ওপর নির্ভরশীল। এমনকি, ভারত থেকে আসা সাতকরা 'সিলেটি সাতকরা' নামে রপ্তানি হয় বলে জানিয়েছেন রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন।

সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নেছাওর মিয়া সাতকরা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনিই প্রথম এই অঞ্চলের সাতকরার পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক নাম নির্ধারণ করেন।

সব ধরনের সাতকরার বৈজ্ঞানিক পরিচিতি ছিল Citrus marcoptera নামে। ড. নেছাওর গবেষণা শেষে এই অঞ্চলের সাতকরার পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন 'Citrus macroptera Montrouz var annamensis Tanaka' হিসেবে।

সাতকরা গাছ সাধারণত ২ থেকে ৩ মিটার লম্বা হয়। এই ফল ৬ থেকে ১০ সেন্টিমিটার বড় হয়। এর পাতাও অন্য যে কোনো লেবুজাতীয় গাছের পাতা থেকে ভিন্ন হয়।

ভরা মৌসুমে সিলেটের যে কোনো বাজারে মান ভেদে একটি সাতকরা ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে আগাম ও দেরিতে পাওয়া সাতকরা আরও বেশি দামেও বিক্রি হয়।

সাতকরা
সিলেটের বাজারে সাতকরা নিয়ে বসেছেন এক দোকানি। ছবি: দ্বোহা চৌধুরী/স্টার

সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকার সাতকরা বিক্রেতা সালেক আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সারাবছরই সাতকরার চাহিদা আছে। তবে মৌসুমে চাহিদা বাড়ে বহুগুণ। প্রবাসী বা পর্যটকরা সিলেটে আসলে এর বিক্রি বেড়ে যায়।'

মৌলভীবাজারের বড়লেখা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালেহ আহমদ জুয়েল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রবীণদের কাছে শুনেছি, সাতকরাকান্দি গ্রাম একসময় সাতকরার জন্যই বিখ্যাত ছিল। এখন এই গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয় হাতে গোনা কয়েকটি গাছ আছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাতকরা একসময় সিলেটের গর্ব ছিল। কিন্তু, এই মুহূর্তে বাণিজ্যিকভাবে সাতকরা উৎপাদন হয় না। বর্তমানে কয়েকটি বাগান আছে। এ ছাড়াও, কয়েকটি বাসায় সাতকরার গাছ আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফলটি নানা রোগে আক্রান্ত। কৃষকদের মধ্যেও সাতকরা চাষের যথাযথ জ্ঞান না থাকায় বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে না। এখন সাতকরার জলবায়ু-সহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল নতুন জাতের প্রয়োজন।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, 'দেশের বাজারের চাহিদা বর্তমানে ভারত থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ভারতীয় সাতকরাই সিলেট থেকে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।'

সাতকরা
জৈন্তাপুরে সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রে সাতকরা গাছ। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

সিলেট কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে সিলেটে ১ হাজার ৭৮ টন লেবু জাতীয় ফল আমদানি হয়েছে। এর বড় অংশ সাতকরা।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো জানিয়েছে, একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ৯১ হাজার ৬৩৯ ডলারের লেবুজাতীয় ফল বিদেশে রপ্তানি করেছে। এর বড় অংশ সাতকরা।

সিলেটে প্রায় ৬ দশক ধরে লেবু জাতীয় ফল নিয়ে গবেষণা করছে 'সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র'। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এ প্রতিষ্ঠান ২০০৪ সালে সাতকরার একটি জাত উদ্ভাবন করে নাম রেখেছিল 'বারি সাতকরা ১'।

গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এমএইচএম বোরহানউদ্দিন ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাতকরা বন্যজাতের স্পর্শকাতর ফল। গাছের বৃদ্ধিও খুব ধীর। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে সাতকরা চাষে আগ্রহী হোন না।'

তিনি আরও বলেন, 'সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র সম্প্রতি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি পেয়েছে। দ্রুতই সাতকরার উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে গবেষণা শুরু করা যাবে বলে আমরা আশাবাদী।'

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

11h ago