ফু-গো বেলুন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হতে জাপানের শেষ প্রচেষ্টা

ফু-গো বেলুন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হতে জাপানের শেষ প্রচেষ্টা
ফু-গো বেলুন। ছবি: ফ্লায়িংম্যাগ.কম

১৯৪৫ সালের ৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য ওরেগনের ছোট্ট ব্লাই শহরে এক বিশেষ ধরনের বেলুন বিস্ফোরিত হয়ে ৬ জন নিহত হন। যাদের মধ্যে ৫ জনই শিশু। নিহতরা সবাই তখন বাইরে পিকনিক করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে এটি ছিল একমাত্র হতাহতের ঘটনা। আর যে বেলুনের কারণে এই ঘটনাটি ঘটে, সেটি ছিল যুদ্ধে সব দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়া জাপানিদের যুদ্ধজয়ের শেষ চেষ্টার অংশ।

যে বেলুনের কথা বলা হচ্ছে, সেটির নাম ফু-গো বেলুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা যখন বুঝতে পারলেন তাদের পরাজয় অতি সন্নিকটে, তখন যুদ্ধ জয়ের শেষ চেষ্টা হিসেবে জাপানি বিজ্ঞানীরা এই বেলুনটি আবিষ্কার করেন। জাপানিরা যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী টোকিওসহ জাপানের বড় বড় শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এসব হামলা জাপানিদের আরও ক্ষেপিয়ে তোলে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে হামলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও কোনো উপায় বের করতে পারছিল না। ধারাবাহিক চেষ্টার এক পর্যায়ে তারা এই ফু-গো বেলুন আবিষ্কার করে। এটি কোনো ইঞ্জিনে চলে না। বাতাসের গতিবেগের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে জাপানিরা তাদের ভূখণ্ড থেকে এই বেলুন ছাড়তো এবং বিস্ফোরকভর্তি বেলুনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে এসে পড়তো।

ফু-গো বেলুন। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

  

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পশ্চিমাঞ্চলে এই ধরনের অন্তত ২৮৫টি ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করেছিল। যদিও ওরেগনের ওই ঘটনা ছাড়া আর কোথাও কখনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আমেরিকানরাও তখন জাপানিদের এই নতুন অস্ত্র সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। মার্কিন সরকার তখন এগুলোকে মিডিয়ায় প্রকাশ করতে দিত না মূলত দুটি উদ্দেশ্যে- এক. জাপানিদের সাফল্যের কথা মিডিয়ায় প্রচার হোক, সেটা মার্কিন সরকার ঠেকাতে চেয়েছিল, আর দুই. মার্কিন জনগণকে অহেতুক আতঙ্ক থেকে মুক্তি দেওয়া।

ফু-গো বেলুন নিয়ে গবেষণা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে ঘটনাপ্রবাহ, তাতে এই অস্ত্রের ব্যবহার এত দেরিতে হওয়াটা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। কারণ, ততদিনে জাপানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল এবং মাত্র কয়েক মাস পরে, সেপ্টেম্বর মাসে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পন করেছিল। বেলুনের ব্যবহার দেরিতে করলেও জাপানিরা এটি নিয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা করেছিল।

১৯৪৫ সালের এপ্রিলে টোকিসহ জাপানের বড় শহরগুলোতে মার্কিন সেনাবাহিনী 'ডুলিটল রেইড' নামে এক বিশাল বোমা হামলা পরিচালনা করে। এই হামলা ছিল জাপানি সাম্রাজ্যের প্রতি চরম অবমাননাকর এবং দেশটির সৈন্যদের মনোবলের উপর এক বড় আঘাত। এই হামলার পর ক্ষুব্ধ জাপানি সেনাবাহিনী যেকোনো উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে হামলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দুটি- মার্কিন জনগণকে আতঙ্কিত করা এবং জাপানি সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করা। এই উদ্দেশ্যেই ফু-গো বেলুন আকাশে ছাড়া হয়।

ফু-গো বেলুন। ছবি: মিলিটারি.কম

একেবারে সাদামাটা অস্ত্র

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, ফু-গো বেলুন ছিল সে তুলনায় নস্যি। এক কদম এগুলো দুই কদম পিছিয়ে যাওয়া, এটাই ছিল ফু-গো বেলুন নিয়ে গবেষণার ইতিহাস। এই বেলুনের সাফল্য ছিল অনেকটা বোতলে চিঠি লিখে সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে প্রাপকের হাতে পৌঁছার আশা করার মতো। বেলুনগুলো রাবার বা ভিনাইল দিয়ে তৈরি করা হয়নি। বরং ধান দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের কাগজ দিয়ে বেলুনটি তৈরি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বেলুনগুলো তৈরি করা হয়েছিল বিশালাকারভাবে, ৩০ ফুট চওড়া ব্যাসে, যাতে সেগুলো ব্যাটারি, পর্যাপ্ত বিস্ফোরক এবং আলটিটিউড নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাসহ উড্ডয়ন করতে পারে। হাইড্রোজেন গ্যাসের সাহায্যে বেলুনগুলো উড্ডয়ন করতো। বেলুনগুলোতে কোনো নেভিগেশন সিস্টেম ছিল না। বরং সেগুলোতে জেট স্ট্রিম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। জাপানি বিজ্ঞানী ওয়াসাবুরো ওইশি এই প্রযুক্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন। বাতাসের গতিবেগও ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটারি চালিত টেলিমেট্রিক ডিভাইসের সিগন্যালের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারতেন যে বেলুনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের দিকে কীভাবে এবং কোন উচ্চতায় অগ্রসর হচ্ছে।

ফু-গো বেলুনের ব্যর্থতা

জাপানি বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ শ্রমের পরও ফু-গো বেলুন প্রকল্পটি প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি। বরং এই বেলুনগুলো দিয়ে সামান্য কিছু অগ্নিসংযোগই করা গেছে শুধু। কাকতালীয়ভাবে একটি বেলুন ওয়াশিংটন রাজ্যের বিদ্যুৎ সংযোগের উপর বিধ্বস্ত হওয়ার পর পুরো রাজ্যের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিছু কিছু বেলুন মিশিগান ও টেক্সাস পর্যন্তও চলে গিয়েছিল, কিন্তু তাতে জাপানিদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। 

১৯৪৫ সালে ওরেগনে ওই দুর্ঘটনার পর মার্কিন সেনাবাহিনী অবশেষ জনসম্মুখে এই বেলুনগুলোর কথা স্বীকার করে এবং এই ধরনের বেলুন ও বেলুনের কারণে হওয়া হতাহতের যেকোনো ঘটনা সেনাবাহিনীকে জানানোর অনুরোধ করে। এমনকি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এই ধরনের কিছু বেলুনের সন্ধান পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এখনো যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম-উত্তরাঞ্চলের দুর্গম এলাকায় এই ধরনের বেলুনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে এবং সেগুলোতে শত শত বোমা ও বিস্ফোরক থাকতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

6h ago