নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়ে কেন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর দুই আগে ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগে কর্মীর চেয়ে নেতা বেড়ে যাচ্ছে। এটা দলের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। তাই আমরা নেতা নয়, কর্মী চাই।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর দুই আগে ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, 'আওয়ামী লীগে কর্মীর চেয়ে নেতা বেড়ে যাচ্ছে। এটা দলের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। তাই আমরা নেতা নয়, কর্মী চাই।' (প্রথম আলো, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)

তার এই বক্তব্যের ৬ বছরের মাথায় গত ৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় 'নেতার ভারে' মঞ্চ ভেঙে পড়ে যান ওবায়দুল কাদের।

তার মানে কী এই যে, ৬ বছর আগে তিনি যে বলেছিলেন ‌‌‌নেতা নয়, কর্মী চান— সেই কথাকে দলের কর্মীরা আমলে নেননি? সবাই কেন নেতা হতে চান? সবাই কেন মঞ্চে উঠতে চান? কেউ কেন কর্মী হতে চান না?

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনেও ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, 'দেশে এখন কর্মী নেই, সবাই নেতা। বাংলাদেশ মনে হয় নেতা উৎপাদনের কারখানা। এখন কর্মী উৎপাদন সংকুচিত হয়ে গেছে। নেতা বেশি হওয়ায় দুর্ভোগও বেশি। নেতা বেশি হওয়ায় বক্তৃতাও বেশি। কিন্তু তাদের সে বক্তৃতা অনেকে শুনতে চায় না।'

সবশেষ মঞ্চ ভেঙে পড়ে যাওয়ার পরেও ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'এত নেতা আমাদের দরকার নাই। আমাদের আরও কর্মী দরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট কর্মী দরকার। যেকোনো মঞ্চে গেলে সামনের লোকের থেকে মঞ্চে লোক বেশি। কেন? এত নেতা কেন? নেতা উৎপাদনের এত বড় কারখানা আমাদের দরকার নাই। কর্মী উৎপাদনের কারখানা দরকার, সেটাই হোক ছাত্রলীগ। (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৬ জানুয়ারি ২০২৩)

প্রসঙ্গত, গত ৬ জানুয়ারি বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মঞ্চ ভেঙে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রলীগ নেতারা ওবায়দুল কাদেরকে জড়িয়ে ধরলে তিনি বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পান। অতিরিক্ত মানুষ ওঠায় মঞ্চ ভেঙে পড়েছে বলে নেতাকর্মীদের ধারণা।

খবর বলছে, অনুষ্ঠানের পুরো সময়ে মঞ্চে ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। এমনকি অননুমোদিতভাবে অবস্থান করছিলেন অনেক নেতাকর্মী।

মঞ্চ ভেঙে পড়ার এই ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে এ বিষয়ে একটি গণমাধ্যমকে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, 'রেওয়াজ অনুযায়ী শোভাযাত্রার অনুষ্ঠানে সাবেক নেতৃবৃন্দ স্টেজে থাকেন। আমাদের স্টেজের গাঁথুনি যে পরিমাণ মজবুত করার কথা ছিল সেটা না করার কারণে এ ঘটনা ঘটলো।'

তবে মঞ্চ কতটা মজবুত করে বানানো হয়েছিল, কিংবা প্রত্যাশিত সংখ্যার কত গুণ নেতা মঞ্চে উঠেছিলেন, সেই তর্কে না গিয়েও এটা বলা যায়, ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ছাত্রলীগ আসলে একটি নেতা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। কমিটিতে সহ-সভাপতি এবং বিভিন্ন উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক হিসেবে যতজনকে পদ দেওয়া হয়, তাতে কমিটির আকার হয় বিশাল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব পদ দেওয়া হয় মূলত অনেক সংখ্যক কর্মীকে খুশি করতে কিংবা তাদেরকে কোনো না কোনো কাজের পুরষ্কার দিতে। কমিটিতে পদ দেওয়া নিয়ে বাণিজ্য তথা অর্থ লেনদেনের খবরও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো বটেই। রাজনৈতিক দলের পদ-বাণিজ্য এখন আর অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়।

এরকম পরিবার এখন বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যে পরিবারে দুয়েকজন নেতা নেই। পাড়া-মহল্লায় নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের প্রদর্শবাদিতাও বেশ চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ তারা যখন রাস্তায় বের হন অসংখ্য মোটরসাইকেল তার সামনে-পেছনে থাকে, যাতে মানুষ বুঝতে পারেন নেতা আসছেন। এই মোটরবাইক শোভাযাত্রায় নেতার চলাচলের দৃশ্য রাজধানী ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে বেশি এবং মোটরসাইকেল সহজলভ্য হওয়ায় এই দৃশ্য এখন নিত্যনৈমিত্তিক।

তবে নেতা হওয়ার এই প্রবণতা যে শুধু ছাত্রলীগেই আছে তা নয়। বরং সব আমলে সব ক্ষমতাসীন দলেই এই প্রবণতা ছিল। কারণ সরকারি দলের মূল দল কিংবা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা হতে পারলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা সুযোগ-সুবিধা নেওয়া যায়। সেটা বৈধ-অবৈধ দুভাবেই।

সাম্প্রতিক বছরগুলো 'বঙ্গবন্ধু' ও 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দ দুটি জুড়ে দিয়ে সংগঠন গড়ে তোলার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তাতে এই দুটি শব্দযুক্ত সংগঠনের সংখ্যা যে কত, সেটি বিরাট গবেষণার বিষয়। কেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দ যুক্ত করে সংগঠন গড়ে তোলা হয়, সে প্রশ্নের উত্তর কারো অজানা নয়।

অধিকাংশ সময়ই এইসব সংগঠন গড়ে তোলার পেছনে যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাজ করে, তা নয়। বরং এসব সংগঠন গড়ে তোলা হয় নেতা হওয়ার জন্য এবং এসব সংগঠনের ব্যানারে নানা কর্মকাণ্ড করে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য। আবার সংগঠনের নামের সঙ্গে 'বঙ্গবন্ধু' ও 'মুক্তিযুদ্ধ' থাকলে যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী সাধারণত তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে না এবং সামাজিকভাবে এইসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সমীহ করে—সে কারণেও এই ধরনের সংগঠন গড়ে উঠে। এসব কারণেও সমাজে এখন নেতার সংখ্যা অনেক। বলা যায়, নেতার ভারে দেশ ন্যুব্জ।

নেতা হওয়ার প্রক্রিয়াও এখন সহজ হয়েছে। ষাটের দশকে রাজনীতি করে যারা নেতা হয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যাবে, নেতা হওয়ার জন্য তাদের কী পরিমাণ পড়াশোনা করতে হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এখন নেতা হওয়ার জন্য পড়াশোনা তো দূরে থাক, কোনো ত্যাগ স্বীকারেরও প্রয়োজন হয় না। বড় নেতার সঙ্গে থাকলে এবং নেতাকে খুশি করতে পারলেই কমিটিতে কোনো না কোনো পদ বাগানো যায়। আর একবার পদ পেলে সেই পদ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।

নেতা হওয়ার আরেকটি সহজ তরিকা পোস্টার। সামাজিকভাবে কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই— এমন অসংখ্য মানুষের ছবি সম্বলিত পোস্টারে সারা দেশ ছেয়ে গেছে। নববর্ষ বা ঈদের শুভেচ্ছাসহ নানা উসিলায় এসব কথিত নেতা নিজেদের বিরাট ছবি, তার উপরে জীবিত ও প্রয়াত জাতীয় নেতাদের ছবি দিয়ে পোস্টার ও ব্যানার সাঁটিয়ে দেন। সারা দেশে এরকম পোস্টার নেতার তালিকা করা হলে সেটি হাজার বা লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ দেশে পোস্টার নিয়ন্ত্রণ আইন আছে। কতজন এই আইনের খবর রাখেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। এমনকি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও প্রশাসনের মানুষও যে এই আইনটি সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন, সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

হাল আমলে নেতা হওয়ার আরেকটি মাধ্যম টেলিভিশনের টকশো। অনেকেই নানা উপায়ে; টেলিভিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে নিয়মিত টেলিভিশনের টকশোতে গিয়েও বড় নেতা হয়ে উঠেন। তারা টকশোতে সমসাময়িক নানা বিষয়ে দলের পক্ষে কথা বলেন, সাফাই গান। এভাবে দলের নীতি-নির্ধারকদের সুনজরে আসেন এবং একটা সময় দলে বড় পদ-পদবি পান। শুধু নিজের নয়, অনেক সময় পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নেতা হওয়ার দরজা খুলে দেন। অথচ যখন দেশে এত টেলিভিশন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপট ছিল না, তখনও দলে নেতা হওয়া যেতো। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটি ছিল ভিন্ন।

প্রশ্ন হলো, কেন সবাই নেতা হতে চান? কেন অন্তত সহ-সভাপতি কিংবা উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক হলেও খুশি? কারণ ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো পদে থাকলেই পয়সা আয়ের একাধিক দরজা খুলে যায়। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ নেতাই তাদের এই পরিচয় ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত স্বার্থে।

যে কারণে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কিংবা সংকটে এই নেতাদের কতজন নিঃস্বার্থভাবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান আর কতজন এই পরিচয়কে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন— সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে ওবায়দুল কাদেরের মতো সিনিয়র নেতা 'নেতা নয় কর্মী চাই' বললেও আদতে সবাই নেতাই হতে চান। কারণ নেতা হলেই লাভ। আর যখন নেতার সংখ্যা কর্মীর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে, তখন নেতাদের ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়বে— সেটিই বোধ হয় স্বাভাবিক।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Women MPs in reserved seats: How empowered are they really?

Fifty-two years ago, a provision was included in the constitution to reserve seats for women in parliament for a greater representation of women in the legislative body.

8h ago