বান্দরবানের গহীনে অভিযান, ‘কবর’ খুঁড়েও মেলেনি জঙ্গির মরদেহ

বান্দরবানের রুমায় দুর্গম পাহাড়ের খাদে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া’ ও কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পরিত্যক্ত গোপন আস্তানা এবং মারা যাওয়া এক জঙ্গিকে দাফন করা হয়েছে বলে তথ্য পায় র‍্যাব।
ছবি: সংগৃহীত

বান্দরবানের রুমায় দুর্গম পাহাড়ের খাদে 'জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া' ও কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পরিত্যক্ত গোপন আস্তানা এবং মারা যাওয়া এক জঙ্গিকে দাফন করা হয়েছে বলে তথ্য পায় র‍্যাব।

জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৫ জানুয়ারি রোববার র‍্যাব ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে ওই অস্তানায় অভিযান চালায়। প্রায় ৩ ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে পরনের দুটি কাপড় ও ট্রাউজার পাওয়া গেলেও কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

গত ১১ জানুয়ারি থানচি ও রোয়াংছড়ি থেকে 'জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার' ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর রাঙ্গামাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করা হয়। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিমান্ডে নেওয়ার পর রুমায় দুর্গম পাহাড়ের খাদে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পরিত্যক্ত গোপন আস্তানা এবং মারা যাওয়া এক জঙ্গিকে দাফন করা হয়েছে বলে তথ্য পায় র‍্যাব।

জঙ্গি আস্তানাটি রুমার রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে হলেও থানচি উপজেলার সদর থেকে ২৯ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। রুমা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। থানচি হয়ে ৭ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হেটে লুয়াংমুয়ালপাড়ায় অভিযানে যায় র‌্যাব। 

অভিযানে থাকা স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, পুরো পাড়াজুড়ে ছিল জনমানবশূন্য বাড়িঘর। ১৪টি পরিবারের প্রত্যেক বাড়িতে ধানের গোলা, ব্যবহারের আসবাব ও জিনিসপত্র রয়েছে। বম জনগোষ্ঠীর গৃহপালিত প্রাণী গয়ালও চরে বেড়াতে দেখা গেছে। 

পাশের তামলাও পাড়ার বাসিন্দারা জানান, পাড়া এলাকায় কেএনএফ ও জঙ্গিরা গোপন আস্তানা করার পর থেকে লুয়াংমুয়ালপাড়া ও পাশের পাইনুয়ামপাড়ার বাসিন্দারা চরম সংকটের মধ্যে পড়েছিলেন। জঙ্গি আস্তানার আশপাশে পাড়াবাসীরা পাল্লা করে জঙ্গিদের খাদ্য সরবরাহ, গয়াল, মুরগি, ছাগল দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নানামুখী চাপে ও অত্যাচারে ২ পাড়ার ২৭টি পরিবারের সবাই গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। 

পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া পরিবারগুলো এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ বলতে পারছেন না। 

অভিযানে লুয়াংমুয়ালপাড়া থেকে কিছু দূরে গহিন জঙ্গলবেষ্টিত প্রায় দেড় হাজার ফুট গভীর পাহাড়ি খাদের ঝিরির তীরে কেএনএফ ও জঙ্গিদের গোপন আস্তানা পাওয়া যায়। ভেঙে ফেলা পরিত্যক্ত আস্তানায় শার্ট, প্যান্ট, ট্রাউজার, ট্র্যাকসুট, রান্নার সরঞ্জাম (হাঁড়িপাতিল) ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। খাদের নিচে বাঁশঝাড়ে ঢাকা আস্তানায় সূর্যের আলো না পৌঁছানোয় এলাকাটি প্রচণ্ড ঠান্ডা ছিল।

খন্দকার আল মঈন জানান, আল আমিন নামের এক জঙ্গি ওই আস্তানায় মারা গেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়চোপড় থেকে একটি ট্র্যাকস্যুট ছেলের বলে ধারণা করে কুড়িয়ে নিয়েছেন আল আমিনের বাবা। আস্তানা থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের ঢালে একটি কবরের মতো মাটিচাপা দেওয়া স্থান পাওয়া যায়। সেটি খনন করে বাঁশের টুকরা ও দুটি কাপড় ছাড়া কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি।

মানুষশূন্য লুয়াংমুয়ালপাড়া এলাকায় অভিযানের সময় হেলিকপ্টারে র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক মশিউর রহমান, আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক খন্দকার আল মঈন, রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন শিবলী, রুমা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলমগীর হোসেন র‍্যাবের ওই ২ কর্মকর্তার সঙ্গে ছিলেন। তবে অভিযানের  সময় পাহাড়ি পথ বেয়ে গভীর খাদে রশি ধরে ঝুলতে ঝুলতে নামতে না পারায় সবাই পরিত্যক্ত গোপন আস্তানায় যেতে পারেননি।'

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, 'পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে থাকা জঙ্গিদের ধরতে অক্টোবর থেকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। জঙ্গি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। মৃত জঙ্গির মরদেহ কবর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।' 

খন্দকার মইন আরও বলেন, 'গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে বান্দরবানের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে দুগর্ম এলাকায় জঙ্গিবিরোধী র‌্যাবের অভিযান চলছে। প্রথমাবার ৭ জন জঙ্গীসহ স্বশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের ৩ জনকে আটক করে র‌্যাব। পরবর্তীতে গত বুধবার ১১ জানুয়ারি রোয়াংছড়ি এবং থানচি থেকে আরও ৫ জঙ্গিকে আটক করার পর আদালতে মাধ্যমে রিমান্ডে নিলে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধানে নামে র‌্যাব।'

তিনি আরও বলেন, 'কবরে মরদেহ পাওনা না গেলেও ওই জায়গা থেকে ৫ রাউন্ড গুলি ও সরঞ্জাম উদ্ধার করে যৌথ বাহিনী।'

খন্দকার মইন বলেন, 'দুর্গম ওই এলাকাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি ও কেএনএফ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযানের কারণে সেখান থেকে জঙ্গিরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। যার কারণে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন এলাকাবাসী।'

তবে পাহাড়ে জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালানোর কথাও জানান র‌্যাব কর্মকর্তারা।

র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত অভিযানে ১২ জঙ্গি ও ১৪ কেএনএফ সদ‍স‍্যকে আটক করেছে র‌্যাব ও সেনাবাহিনী। র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর অভিযানের ফলে লুয়াংমুয়াল বম পাড়া, ফাইনুয়াম পাড়া, থিনরদোয়ালপি পাড়া, চেকখ্যংপাড়াসহ আশপাশের কয়েকটি ছোট ছোট পাড়া থেকে স্থানীয়রা ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। এসব দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গিসহ কেএনএন সদস্যদের উৎখাত করে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

Comments