যে কারণে 'মমি' শব্দটি আর ব্যবহার করতে চাইছে না জাদুঘরগুলো
মমি শব্দটি এসেছে আরবি 'মামিয়াহ' থেকে। যার অর্থ টার (আলকাতরা) কিংবা বিটুমিন।
সারা বিশ্বে জাদুঘরগুলোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রদর্শনযোগ্য জিনিস এই মমি, এমনকি মমি নিয়ে ব্যাপক ব্যবসাসফল সিনেমাও তৈরি হয়েছে।
'মমি' শুনলেই মনে পড়ে প্রাচীন মিশরীয় মানব অবশেষের কথা। কিন্তু সেই মমিগুলোকে এখন অন্য নামে ডাকছে ব্রিটেনের কিছু জাদুঘর।
সিএনএন ও ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মমি না বলে এখন তারা মমিকৃত ব্যক্তি নাম ব্যবহার করছেন, যাতে করে বোঝানো যায় তারা একসময় আমাদের মতোই জীবিত মানুষ ছিলেন।
উত্তরপূর্ব ইংল্যান্ডের নিউক্যাসলে অবস্থিত গ্রেট নর্থ মিউজিয়ামের স্থাপত্যের সহকারী রক্ষক জো এন্ডারসনের মতে, জনসংস্কৃতিতে মমিকে যেভাবে তুলে ধরা হয় তার সঙ্গে পার্থক্য তৈরি করবে মমিকে এমন বিভিন্ন নামে ডাকা।
২০২১ সালের মে মাসে এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, 'পপ কালচারে মমির অভিশাপ ও এ সম্পর্কিত কিংবদন্তী প্রচার এবং তাদের অতিপ্রাকৃত দানব হিসেবে উপস্থাপনের ফলে তাদের মনুষত্ব থাকার ব্যাপারটির অবমূল্যায়ন ঘটেছে।'
লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মিশর ও সুদান বিভাগের রক্ষক ড্যানিয়েল আন্তোইন বলেন, 'গত ৩০ বছর ধরে মমি করে রাখা মানুষগুলোর পরিচয় তুলে ধরার ভালো উপায় গত ৩০ বছর ধরে খোঁজা হচ্ছে। সারা বিশ্ব থেকে পাওয়া মানব অবশেষ আছে আমাদের। আমরা কোন নামে ডাকবো তা নির্ভর করছে তাদের কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তার ওপর। সাম্রাজ্য গঠন পূর্ববর্তী মিশরে প্রাকৃতিক মমি ছিল। তাদের আমরা প্রাকৃতিক মমিই বলবো, কারণ তাদের কৃত্রিমভাবে মমিতে পরিণত করা হয়নি।'
জাদুঘর কর্তৃপক্ষের মতে, মমিকৃত অবশেষ টার্মটি ব্যবহার করলে পর্যটকরা এটা ভাবতে উৎসাহিত হবেন যে, এই ব্যক্তিরাও একসময়ে জীবিত ছিলেন।
গ্রেট নর্থ মিউজিয়ামের ব্যবস্থাপক অ্যাডাম গোল্ডওয়াটার বলেন, 'দর্শনার্থীদের ওপর করা প্রাথমিক পর্যায়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, হ্যাংকক সিনেমায় প্রদর্শিত ইরতাইরু নামের মমিকৃত এক নারীকে দেখে বহু দর্শনার্থী বুঝতেই পারেননি তিনি সত্যিকারের একজন মানুষ ছিলেন।'
'তাকে আরো সংবেদনশীলতার সঙ্গে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলে, আমরা আশা রাখি আমাদের দর্শনার্থীরা তার প্রকৃত রূপ বুঝবে; কৌতূহল জাগানো কোনো পণ্য নয়, বরং তিনি যে একসময় আমাদের মতোই একজন মানুষ ছিলেন ও তার মৃত্যুর পর মৃতদেহের শেষকৃত্য বিষয়েও যে তার সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস ছিল তা মানুষ বুঝবেন,' বলেন তিনি।
'মমি' শব্দটির বিষয়েও জাদুঘরগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
ব্রিটিশ মিউজিয়াম এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা 'মমি' টার্মটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেনি। তাদের বিভিন্ন গ্যালারিতে শব্দটি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
তবে এর সঙ্গে তারা এও বলছে, 'আমাদের সাম্প্রতিক প্রদর্শনে ব্যবহৃত হয়েছে মামিফায়েড রিমেইনস অব..... এবং জানার সাপেক্ষে যুক্ত হয়েছে মমিকৃত ব্যক্তির নাম যাতে এটা জোরালোভাবে বোঝানো যায় যে, মমিকৃত ব্যক্তিরা একসময় জীবিত মানুষই ছিলেন।'
তবে এডিনব্রতে (এডিনবার্গ) অবস্থিত 'ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব স্কটল্যান্ড' এর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'মমি টার্মটা পুরনো নয়, বরং আধুনিক। এ কারণে এটি একটি বর্ণনামূলক বিশেষণ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়, যেমন- মমি মাস্ক, মমি কেস ও মমি ব্যান্ডেজ- সবগুলোই আমাদের লেবেলে ব্যবহৃত হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বহু জাদুঘরের মতোই, আমাদের সংগ্রহগুলোর ক্ষেত্রে আমরা কীসে গুরুত্ব দিই ও কীভাবে সেসব প্রদর্শনের ব্যবস্থা করি- তা ঠিক হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক চিন্তা ও কাজ দ্বারা যা পৃথিবী সম্পর্কে জাতিবাদী ও জাতিগত বৈষম্যমূলক বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।'
'এর উত্তরে, কীভাবে আমরা দর্শনার্থীদের কাছে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক অতীত তুলে ধরছি, তার মাধ্যমেই তাদের চোখে প্রতিফলন ঘটছে আমাদের। আমাদের গ্যালারিগুলোয়, ঐতিহাসিক পক্ষপাত নির্দেশ করার জন্য ডিসপ্লে ও লেবেলগুলোয় পরিবর্তন আনা হচ্ছে,' বলেন তিনি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, জাদুঘরটি মমিকৃত একটি মানুষকে সঙ্গ দেওয়া প্যানেলটির কাজে পরিবর্তন আনছে ও ফোকাস করছে এমন জায়গায় যে, কত আগে পশ্চিমা সভ্যতার ধারণা মিশর গ্রহণ করেছিল; যার ফলে প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে আধুনিক মিশর।
আগে এই প্যানেল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা স্যার কলিন স্কট মনক্রিইফ কীভাবে নীল নদের ধারে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার পর মানব অবশেষ (মমিকৃত ব্যক্তিকে) উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন তা বর্ণনা করেছিল।
Comments