অর্থনৈতিক সংকটে লোকসানে ৪৩ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও মিউচুয়াল ফান্ড

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

অন্তত ৪৩টি তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও মিউচুয়াল ফান্ড চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত লোকসানে পড়েছে।

মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন, কাঁচামাল ও জ্বালানির উচ্চ মূল্য এবং বর্ধিত মুদ্রাস্ফীতির চাপের মধ্যে কম বিক্রি হওয়া এই লোকসানের জন্য দায়ী করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্ত প্রায় ২১৮টি প্রতিষ্ঠান ২০২২-২৩ সালের প্রথমার্ধের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সন্ধানী অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সংকলিত তথ্য অনুসারে, তাদের মধ্যে ৪৩টি প্রতিষ্ঠান নতুন করে লোকসানের কথা জানিয়েছে।

এর মধ্যে ১৮টি মিউচুয়াল ফান্ড, ১০টি প্রকৌশল খাতের প্রতিষ্ঠান, ৬টি পোশাক শিল্পের প্রতিষ্ঠান এবং ৩টি বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া, রয়েছে খাদ্য প্রস্তুতকারক ও ট্যানারি।

বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে এসিআই, জিপিএইচ ইস্পাত, রানার অটোমোবাইলস ও বিএসআরএম লিমিটেডের মতো বড় নামগুলো জুলাই-ডিসেম্বর মাসে লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জিপিএইচ ইস্পাত চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৮৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা লোকসান দেখিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৯৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছিল।

বিএসআরএম লিমিটেড চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১১০ কোটি ১৮ লাখ টাকা লোকসানের কথা জানিয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তারা ২৪১ কোটি ১৫ লাখ টাকা মুনাফার ঘোষণা দিয়েছিল।

১ বছর আগের তুলনায় ২ প্রান্তিকে লোকসানের সম্মুখীন অন্যান্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, অ্যাপেক্স ট্যানারি, সাফকো স্পিনিং মিলস, প্রাইম টেক্সটাইল স্পিনিং মিলস, রহিম টেক্সটাইল মিলস ও গোল্ডেন হারভেস্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। ২২টি প্রতিষ্ঠান আগেও লোকসানে ছিল, এখনো লোকসানে রয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের নির্বাহী সদস্য আনিস এ খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনা মহামারি, বৈশ্বিক পণ্য সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, টাকার অবমূল্যায়ন, কাঁচামালের উচ্চ মূল্য এবং চাহিদা হ্রাসের সম্মিলিত প্রভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।'

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা কটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

এই যুদ্ধের প্রভাবে ইতোমধ্যে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট দেখা দেয় এবং বৈশ্বিক পণ্য বাজার অস্থির হয়ে ওঠে।

গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে পড়া থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিও রেহাই পায়নি। চলতি অর্থবছরেও এই চাপ অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১৯ শতাংশ কমে ৩৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

এর ফলে কোম্পানিগুলো মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে ক্রমাগত অসুবিধার মুখে পড়ছে। এর সঙ্গে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হওয়ায় কাঁচামালের দামও বেড়েছে বলে জানান আনিস এ খান।

মার্কিন ডলারের ঘাটতির কারণে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে টাকার দাম কমেছে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে টাকার দাম প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে, যা আমদানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

এর ফলে, বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত প্রায় ৭০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে কিংবা কম মুনাফা করেছে।

আনিস এ খান বলেন, 'তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেকে নতুন করে লোকসান করেছে, আবার অনেকে কম লাভ করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে মানুষের খরচ কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে সব কোম্পানির মুনাফায়।'

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।

গত ডিসেম্বরে ভোক্তা মূল্য সূচক ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে এবং যুদ্ধের প্রভাব না কমায় ভোক্তা মূল্য সূচকের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সন্ধানী অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর আরিফুল ইসলাম জানান, অর্থবছরের প্রথমার্ধে মিউচুয়াল ফান্ড শিল্প ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ভালো অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে মিউচুয়াল ফান্ড প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল কিন্তু শেয়ারের দাম কমে গেছে। এগুলোর দাম ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে।

মিউচুয়াল ফান্ডগুলো শেয়ার ও বন্ডের মতো সিকিউরিটিজে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। অর্জিত মুনাফার ওপর নির্ভর করে তারা বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়।

জুলাইয়ের শেষে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে শেয়ারের দামে পতন ঠেকাতে প্রতিটি শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে।

গত ডিসেম্বরে ১৬৯টি প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছিল। এর বেশিরভাগই ছোট পুঁজিভিত্তিক সংস্থা, যারা মিউচুয়াল ফান্ড থেকে খুবই কম বিনিয়োগ পেয়েছে।

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বেঞ্চমার্ক সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৪ শতাংশ।

পোশাকখাতসহ যেসব প্রতিষ্ঠান আমদানি নির্ভর, তারা মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে তাদের বেশি খরচ করতে হচ্ছে।

গত আগস্টে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। পেট্রোলের দাম বাড়িয়েছে ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং অকটেনের দাম ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এই সিদ্ধান্তের পর জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনের সামগ্রিক পর্যায়ে।

আনি এ খানের মতে, এখন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে কৃচ্ছ্রতা সাধনের চেষ্টা করছে এবং শিগগির এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পাওয়ার আশায় আছে।

এই বিশ্লেষক জানান, তাদের এই আশা বাস্তবে রূপ নেবে কি না, তা জানতে অপেক্ষায় থাকতে হবে। কেননা, ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান থাকায় অনিশ্চয়তা এখনো রয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
Eid-ul-Azha 2025

Main Eid congregation held at National Eidgah

With due religious solemnity and fervour, the main congregation of Eid-ul-Azha was held at the National Eidgah.

45m ago