পটুয়াখালী

পতিত জমিতে বিনাচাষে লবণসহিষ্ণু গম চাষে সাফল্য

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের গম চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন কৃষকরা। নামমাত্র খরচে গমের আবাদ করে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি গম আবাদের মাধ্যমে গমের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েও ভূমিকা পালন করছে।
পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের গম চাষ। ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের গম চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন কৃষকরা। নামমাত্র খরচে গমের আবাদ করে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি গম আবাদের মাধ্যমে গমের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েও ভূমিকা পালন করছে।

এ পদ্ধতিতে গম আবাদ করলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলায় কমপক্ষে ১ লাখ হেক্টর জমিতে শীতকালে প্রায় ৩ লাখ টন গম উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা (৪৮ টাকা কেজি দরে) বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী জমিতে লবণাক্ততা বেশি। এ কারণে তারা শুধু বর্ষা মৌসুমে আমন ধান আবাদ করতে পারেন। ডিসেম্বরে আমন ধান কাটার পর শুকনা মৌসুমে জমিতে লবণাক্ততা এতটাই বেড়ে যায় যে পরবর্তী বর্ষার আগে সেসব জমিতে আর ফসল ফলানো যায় না। এসব কৃষি জমি বছরের প্রায় ৮ মাসই পতিত থাকে।

পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এমন জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর, যার বেশিরভাগই কলাপাড়া উপজেলায়। আর দেশের উপকূলীয় এলাকায় এ ধরনের পতিত জমির পরিমান কয়েক লাখ হেক্টর।

এ ধরনের পতিত  জমি আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়ার এসিআইএআর (অস্ট্রেলিয়া সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ) প্রকল্পের সহায়তায় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন কেজিএফ) এর অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়ের্স্টান অস্ট্রেলিয়া, সিএসআইআরও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি যৌথ প্রকল্পের আওতায় গেল ২০১৭ থেকে গবেষণা করে আসছে। কলাপাড়া উপজেলার পূর্ব দৌলতপুর ও উত্তর দৌলতপুর গ্রামে দু'টি প্রথক প্রদর্শনীতে মোট ২৮ জন কৃষক গম চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। তাদের সাফল্য দেখে চলতি বছর ওই দুই গ্রামের ৫০ জন কৃষক গম আবাদ করেছেন।

পরীক্ষামূলকভাবে পূর্ব দৌলতপুর গ্রামে বিনাচাষে গমের আবাদ করছেন ১১ কৃষক। প্রত্যেকে ১ বিঘা জমিতে আমন ধান ওঠার আগেই জমি কিছুটা ভেজা থাকা অবস্থায় গম বীজ ছিটিয়ে দেন। এতে জমিতে লবণাক্ততার পরিমান বৃদ্ধির আগেই গম গাছ বেড়ে ওঠে এবং ২/১ বার সেচ দিলেই ৯০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যে গম তোলা যায়।

গমচাষি আব্দুল খালেক জানান, তার জমিতে বছরে একবার আমন ধান হতো, শুকনো মৌসুমে লবণাক্ততার কারণে অন্য ফসল ফলানো সম্ভব হতো না। নতুন পদ্ধতি শেখার পর গত বছর ১ বিঘা জমিতে জমিতে প্রায় ৮ মণ হয়েছে। নামমাত্র খরচে অতিরিক্ত একটি ফসল পাওয়ায় আনন্দিত তিনি।

আরেক গম চষী ফারুক খানও বিষয়টি নিয়ে খুশি। তিনি জানান, 'আমাদের জমি আমন ধান আবাদের পর বছরের প্রায় ৮ মাস পতিত থাকত। এখন এসব জমিতে গম উৎপাদন করতে পেরে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি।'

বিনাচাষে গম আবাদ করে সাফল্য পাওয়ায় এরই মধ্যে অনেক কৃষক প্রকল্প সহযোগিতা ছাড়াই আরও জমিতে গম আবাদ শুরু করেছেন। প্রকল্প না থাকলেও আগামীতে শীত মৌসুমে পতিত জমিতে গম আবাদ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।

এদিকে, উত্তর দৌলতপুর গ্রামে এ প্রকল্পের আওতায় বিএডব্লিউ-১১৪৭ ও বিএডব্লিউ-১২৯০ লবণসহিষ্ণু দুটি জাতের গমের বীজ উৎপাদন করে জমিতে আবাদ করা হয়েছে। সেখানে ১৭ জন কৃষক এক বিঘা করে জমিতে গম আবাদ করছেন। তাদের একজন আমিনুল ইসলাম জানান, গত বছর গম আবাদ ভালো হওয়ায় এবছর তিনি প্রকল্পের এক বিঘা প্রদর্শনী প্লটের পাশাপাশি আরও ৩ বিঘা জমিতে গম আবাদ করেছেন।

মজিবর রহমান নামে আরেকজন চাষি জানিয়েছেন গতবছরের সাফল্যের কারণে এবছর তিনি ৮ বিঘা জমিতে গম আবাদ করেছেন। একমাসের মধ্যে গম পাকবে বলে আশা করছেন তিনি।

কৃষক নুরু পাহলোয়ান বলছিলেন, তাদের এলাকায় আগে কখনও গম চাষ হয়নি। পতিত জমিতে গমের আবাদের আমাদের সাফল্য দেখে এলাকার আরও ৫০ জন কৃষক গম চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আগামী বার এলাকার প্রায় সব কৃষক গম চাষ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন।

প্রকল্পের সাফল্য দেখতে গত সোমবার দুপুরে অস্ট্রেলিয়া সরকারের একটি প্রতিনিধি দল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন এবং তারা গম চাষে নিয়োজিত কৃষকদের সাথে কথা বলেন। প্রকল্পের সাফল্যে তারা সন্তুষ্ট।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় জমির লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে, ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রচুর জমি পতিত থাকছে।

প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং অস্ট্রেলিয়ার সিএসআইআরও যৌথভাবে গমের জাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ৫ বছর ধরে কাজ করছে। প্রথম দুই বছরের গবেষণা থেকে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত দুটি জাতের গম বিএডব্লিউ-১১৪৭ ও বিএডব্লিউ-১২৯০কে লবণাক্ততা সহিষ্ণু জেনোটাইপ হিসবে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অবমুক্তির জন্য মূল্যায়ন করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি জেলা পটুয়াখালী, খুলনা, সাতক্ষীরায় এ ফসলের প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে উপকূল অঞ্চলে কৃষকরা শুষ্ক মৌষুমে অতিরিক্ত একটি ফসল ঘরে তুলতে পারবে।

ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী জানান, আরও বলেন, পটুয়াখালীর ৬ উপজেলা, খুলনার বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় কমপক্ষে এক লাখ হেক্টর লবণাক্ত পতিত জমিকে গম আবাদের আওতায় আনার পরিকল্পনা আছে, যা সম্ভব হলে বছরে কমপক্ষে ৩ লাখ টন গম উৎপাদন সম্ভব।

বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক বলেন, বাংলাদেশের মানুষের আটার রুটি খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০ লাখ টন আমদানি করতে হয়। উপকূল অঞ্চলের পতিত জমিতে গম চাষ করলে গম আমদানির উপর নির্ভরতা কমবে।

Comments