দেশভেদে রমজান পালনে বৈচিত্র্য

ছবি: সংগৃহীত

রমজান মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মাস। মূল ধর্মীয় আচার এক হলেও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন দেশে রমজান মাস পালনে বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই মাসটিতে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ পালন করে যায় তাদের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি। তাই রমজান মাস শুধু যে সিয়াম সাধনার মাস তা নয়, দেশের প্রচলিত ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো চর্চা করার সময়ও বটে!

সংযুক্ত আরব আমিরাত

এক ভিন্নধর্মী আয়োজনের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজানকে বরণ করে নেওয়া হয়। রমজানের আগমন উপলক্ষে আরব আমিরাতে 'হক আল লায়লা' নামে শিশুদের নিয়ে একটি বিশেষ আয়োজন করা হয়। সেখানে রমজানের আগের মাস শাবানের ১৫ তারিখে শিশুরা উজ্জ্বল কাপড় পরে আর ঝোলা কাঁধে দল বেঁধে প্রতিবেশীদের বাড়িতে যায়। দরজায় কড়া নাড়ে আর সুর করে বলে, 'তোমরা আমাদের দাও, আল্লাহ তোমাদের দেবেন। মক্কায় আল্লাহ তার ঘর পরিদর্শন করাবেন।' তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি, বাদাম ও অন্যান্য খাবার সংগ্রহ করে, যা 'খারিতা' নামে পরিচিত।

আরব আমিরাতের বিখ্যাত শহর দুবাইয়ের অধিবাসীরা ভারী খাবার খেয়ে ইফতার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেখানে হারিরা নামক ভেড়ার মাংস ও মসুর ডাল দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের স্যুপ খাওয়া হয় রোজা ভাঙার পর। তাছাড়া তাদের খাদ্য তালিকায় আছে ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি ওউজি, আছে মাছ দিয়ে তৈরি আইটেম কউশা মাহসি। এছাড়া খাওয়া শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে চিজ দিয়ে তৈরি পেস্ট্রি খাওয়া হয়, যার নাম কুনাফেহ। তবে ইফতারের ক্ষেত্রে খেজুর ও দুধ এই ২টি খাবার দুবাইয়ের রোজাদারদের পাতে থাকবেই থাকবে।

মিশর

মিশরীয়দের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ইতিহাস কে না জানে! রমজান মাসকে ঘিরেও মিশরে থাকে জমকালো আয়োজন। রমজানে এখানকার বাড়ি-ঘর ও দোকানগুলোর প্রবেশমুখে রঙিন ফানুস ঝুলিয়ে রাখা হয়। নানা রং ও বৈচিত্র্যে বানানো এই ফানুসগুলো মূলত এক বিশেষ ধরনের লণ্ঠন। ধাতু ও রঙিন কাচ দিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়। রমজান মাসে চারদিকে ঝোলানো এই ফানুসগুলোতে পুরো মিশর আলোকিত হয়, উৎসবের আমেজ বিরাজ করে সারাদেশে।

সেহরির সময় সবাইকে জাগিয়ে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে একদল মানুষ। তাদেরকে মিশরে ডাকা হয় মেসেহারাতি।

তুরস্ক

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে অনন্য তুর্কিরা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে রমজান মাসকে বরণ করে নেয়। মিশরের মতোই একদল মানুষ সেহরির সময় জাগিয়ে তোলে তুরস্কের মানুষকে। তবে সাধারণ উপায়ে নয়, তারা রাস্তায় নামে ঢোল-দামামা নিয়ে।

তাছাড়া এই মাসে প্রতিদিন ৩ বার (সেহরি খাওয়ার সময়, ইফতারের সময় ও সেহরির শেষ সময়) তোপধ্বনি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই তোপধ্বনি দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে রমজানকে স্বাগত জানানো। এই তোপধ্বনি দেওয়ার সময়ই মসজিদের মিনারগুলোতে জ্বালানো হয় 'কানদিল' নামের বাতি। বাতিগুলো জ্বলতে থাকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। তুরস্কে বাতি জ্বালানোর এই ঐতিহ্য শতবর্ষী পুরনো।

ইফতারের সময় খোরমা-খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙা হয়। তুরস্কে ইফতারকে বলা হয় ইফতারিয়া। ইফতারে থাকে নানা আয়োজন। থাকে জলপাই ও পনির দিয়ে বানানো পেস্ট্রি বারেক, গরুর মাংস দিয়ে তৈরি পেসতারমা ও তুর্কি রুটি পিদে।

মরক্কো

আফ্রিকার এই দেশটিতে রমজানকে বরণ করার প্রস্তুতি শুরু হয় ২-৩ সপ্তাহ আগে থেকে। মরক্কোর মানুষ রমজানের আগে তাদের বাড়ি-ঘর নতুন করে রং করায়, বাড়ির চারদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ও রান্নাঘরের যাবতীয় জিনিস একদম নতুনের মতো চকচকে করে তোলে। মরক্কোয় ইফতারকে বলা হয় এফতোর। এ সময় তাদের রাস্তাগুলো পরিণত হয় খাবারের বাজারে।

মরক্কোর অধিবাসীরা একটু বেশি সময় নিয়ে ইফতার করে থাকে। ইফতারে থাকে ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন রিজ্জা, ক্রাচেল, মিস্সামেন, হারিরা, ব্রিওয়াত, স্টিল্লা, হারশা, স্যাল্লো, রিজ্জা। মরক্কোতেও নাফর নামে পরিচিত একদল মানুষ পালন করে সেহরিতে মানুষদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব। তবে এ ক্ষেত্রে তাদেরকে শহরের মানুষ নির্বাচন করে। রমজানের শেষে নাফরদের পুরস্কৃত করা হয়। মাথায় টুপি, পায়ে জুতা আর মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে, সুরেলা গলায় প্রার্থনা সংগীত গেয়ে শহরের অলিগলিতে হেঁটে তারা মানুষকে জাগিয়ে তোলে।

লেবানন

লেবাননে ইফতারের সময় ঘোষণা করা হয় অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে। কামান চালিয়ে তীব্র আওয়াজের মাধ্যমে রোজাদারদের ইফতারের সময় জানিয়ে দেওয়া হয়। লেবানিজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই রীতির নাম মিদফা-আল-ইফতার।

ইতিহাস বলে, এই রীতির জন্ম প্রাচীন মিশরে এবং ইসলামের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এই রীতি প্রচলিত ছিল। লেবাননের মতো বিভিন্ন দেশে এখনও এই রীতি আছে।

কাতার

প্রতি বছর রমজান মাসের ১৪ তারিখ কাতারে শিশুদের নিয়ে পালন করা হয় ভিন্নধর্মী আয়োজন গারাংগাও। এই দিন শিশুরা কাতারের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে মাগরিবের নামাজের পর ব্যাগ নিয়ে গারাংগাও গান গায় এবং বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। এই শিশুদের মিষ্টি ও চকলেট দিয়ে তাদের আনন্দের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মূলত শিশুদের রোজা রাখার প্রশংসা করতে ও তাদের উৎসাহী করতে এই আয়োজন করা হয়ে থাকে।

পাকিস্তান

যুগ যুগ ধরে পাকিস্তানে রমজান মাস উদযাপন করা হয় বাহারি ইফতার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঘটা করে ইফতার করা পাকিস্তানের সংস্কৃতির অংশ। তাদের ঐতিহ্যবাহী ইফতারের তালিকায় থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব, চানা চাট, দই বালাই, কাল্লি (নুডলস্ স্যুপ), নিমকি জাতীয় খাবার নামাক পাড়া, পাপড়, ভেজিটেবল পাকোড়া, ফ্রুট সালাদ ইত্যাদি।

ভারত

ভারতের মুসলিমরা সাধারণত মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে ইফতার করতে পছন্দ করে। তবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র‍্যে ভরপুর এখানকার একেক রাজ্যের ইফতারির আয়োজন একেক রকম। যেমন হায়দরাবাদের লোকজনের খাবারের তালিকায় থাকে হালিম, কলকাতার ইফতারে থাকে খেজুর ও বিভিন্ন ধরনের ফল এবং চিকেন শর্মা, বটি কাবাব, কাটলেটের মতো মুখরোচক খাবার। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারত বিশেষ করে তামিলনাড়ু ও কেরালায় ইফতারের প্লেটে থাকে ননবো কাঞ্জি নামের এক ধরনের খাবার।

মালদ্বীপ

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম প্রধান ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্র ভিন্নধর্মী উপায়ে রোজার মাস উদযাপন করে।  ইফতারের সময়ে মালদ্বীপের কবিরা 'রাইভারু' নামের রমজান সম্পর্কিত এক ধরনের কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন। এই কবিতাগুলো হয় ৩ বা তার বেশি লাইনের। প্রাচীনকাল থেকেই মালদ্বীপে এই রাইভারু আবৃত্তির সংস্কৃতি আছে। তাদের ইফতারে থাকে কুলহি বোয়াকিবা (মাছ দিয়ে তৈরি এক ধরনের কেক), ফোনিবোয়াকিবা (ময়দা দিয়ে বানানো কেক), গুলহা (মাছের কোফতা) ইত্যাদি।

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

7h ago