এশিয়া

এশিয়াজুড়ে উড়োজাহাজ ভাড়ার ঊর্ধ্বগতির কারণ কী?

সার্বিকভাবে আকাশপথে ভ্রমণের খরচ বাড়লেও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যাত্রীরাই সবচেয়ে বেশি ভুগছেন এবং এ সমস্যা সহসাই কাটছেনা বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে যাত্রীর ভিড়। ফাইল ছবি: রয়টার্স
ভারতের ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে যাত্রীর ভিড়। ফাইল ছবি: রয়টার্স

করোনা মহামারির পর উড়োজাহাজ চলাচল ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলেও আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এ বছর এশিয়াজুড়ে যাত্রীদের বাড়তি অর্থ গুণতে হবে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ অঞ্চলে  ফ্লাইটের ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ভাড়া বেড়েছে যথাক্রমে ১২ ও ১৭ শতাংশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীরা ৪ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

আমেরিকান এক্সপ্রেস গ্লোবাল বিজনেস ট্রাভেলের (অ্যামেক্স জিবিটি) তথ্য মতে, ২০১৯ সালে প্যারিস থেকে সাংহাইয়ের বিজনেস ক্লাস টিকিটের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলার, বর্তমানে যা বিক্রি হচ্ছে ১১ হাজার ৫০০ ডলারে।

একই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুসারে, সিঙ্গাপুর থেকে সাংহাইয়ের বিজনেস ক্লাস টিকিটের দামও ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

সার্বিকভাবে আকাশপথে ভ্রমণের খরচ বাড়লেও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যাত্রীরাই সবচেয়ে বেশি ভুগছেন এবং এ সমস্যা সহসাই কাটছেনা বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অ্যামেক্স জিবিটির পূর্বাভাস আরও জানিয়েছে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে এশিয়াগামী উড়োজাহাজের ইকোনমি ক্লাসের টিকিট যথাক্রমে ৯ দশমিক ৫ ও ৯ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে এ বছর। একই হারে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে বিজনেস ক্লাস টিকিটের ক্ষেত্রেও।

পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট ও রুশ আকাশসীমা বন্ধ থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এশিয়া এখনো পুরোপুরি করোনাভাইরাসের সময়ের বিভিন্ন বিধিনিষেধ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।

উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো অনেক আগেই করোনা সংক্রান্ত সীমান্ত বিধিনিষেধগুলো অনেকটা সহজ করলেও দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো এশিয়ার অন্যতম প্রধান গন্তব্যগুলো মাত্র ২০২২ সাল থেকে বিদেশি যাত্রীদের জন্য সীমান্ত খুলতে শুরু করেছে।

চীন দীর্ঘ ৩ বছর পর জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করেছে এবং মাত্র গত সপ্তাহে পর্যটকসহ সকল যাত্রীর জন্য ভিসা দিতে শুরু করেছে।

অনলাইন ট্রাভেল কোম্পানি স্কাইস্ক্যানারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিউ এইটকেন বলেন, 'যেসব অঞ্চলে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারে যত দেরি হবে এবং পূর্ণ সক্ষমতা অনুসারে যাত্রী পরিবহন যত দেরিতে শুরু হবে, ততই বাড়তে থাকবে ভাড়া। এ মুহূর্তে জায়গাটি হচ্ছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল।'

এমনকি চাহিদা বেশি থাকলেও উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো দ্রুত নতুন সেবা (উড়োজাহাজ) যুক্ত করতে পারছে না। কারণ নির্দিষ্ট রুটে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করতে চাইলে গ্রাউন্ড স্টাফ, পজিশন ক্রু, বিমানবন্দরের সঙ্গে সমন্বয় এবং অন্য রুট থেকে সরিয়ে উড়োজাহাজকে নির্দিষ্ট রুটে আনতে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়।

এইটকেন বলেন, 'উড়োজাহাজ শিডিউল নিয়ে পরিকল্পনা করতে কয়েক মাস সময় লাগে।'

চীন আন্তর্জাতিক যাত্রীদের জন্য বিধিনিষেধ তুলে দিলেও এখনো চীন থেকে বহির্গামী বিমানে করোনা মহামারির আগের তুলনায় মাত্র ১৫-২০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করা যাচ্ছে।

এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে দীর্ঘ যাত্রার ফ্লাইটগুলোতেও ২০১৯ সালের তুলনায় বর্তমানে মাত্র ১৭ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করা যাচ্ছে। এয়ারলাইন্সগুলো তাদের সক্ষমতা প্রতিনিয়ত বাড়াচ্ছে। কিন্তু মহামারি পরবর্তী সময়ে চাহিদা মোকাবেলায় যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা যতটা দ্রুত বাড়ানো উচিত, তত দ্রুত বাড়ছে না। বাড়তি চাহিদা ও কম সক্ষমতা হচ্ছে দাম বাড়ার প্রধান উপকরণ।

আরও যেসব কারণে দাম বাড়ছে

গত বছর রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর অনেকগুলো দেশের এয়ারলাইন্সের জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে এসব এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজগুলোকে ভিন্ন পথে ঘুরে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এতে করে ভ্রমণও দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ভাড়াও বাড়ছে। এর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের যাত্রীরা।

অ্যামেক্স জিবিটির প্রতিবেদন মতে, 'টোকিও থেকে লন্ডনগামী একটি ফ্লাইটকে এখন উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর, আলাস্কা, কানাডা এবং গ্রিনল্যান্ডের উপর দিয়ে উড়ে যেতে হয়। এতে প্রায় ৩ ঘণ্টা বাড়তি বেশি সময় ও ৫ হাজার ৬০০ গ্যালন বাড়তি জ্বালানি খরচ হয়, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি'।

জাপানের হানেদা বিমানবন্দরে বাড়ছে যাত্রীর ভিড়। ফাইল ছবি: রয়টার্স
জাপানের হানেদা বিমানবন্দরে বাড়ছে যাত্রীর ভিড়। ফাইল ছবি: রয়টার্স

জ্বালানির দামও প্রায় আশা ছুঁয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মূল উড়োজাহাজ সংস্থা কোয়ান্টাসের প্রধান নির্বাহী অ্যালান জয়েস বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় তার প্রতিষ্ঠানের জ্বালানি খরচ বেড়েছে ৬৫ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, 'জ্বালানির এই বাড়তি দামের কারণেই করোনার আগের সময়ের তুলনায় এখন উড়োজাহাজ ভাড়া বেশি হবে।'

জয়েস আরও বলেন, করোনার দীর্ঘ সময়ে যেসব ক্রুরা কোনো কাজ করেননি, তাদের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবারও কাজে ফেরানো হচ্ছে। এতে সময় লাগছে।

তিনি বলেন, উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকার সময় আমাদের বৈমানিকরা সিডনি ও মেলবোর্নে বাস চালিয়েছেন। তাই এসব বৈমানিকদের আবারও ককপিটে ফেরাতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।

যাত্রীদের উপর প্রভাব

টিকিটের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীদের উপর প্রভাব পড়লেও তারা যাত্রা বাতিল করছেন, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই খাতের পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হবে না।

এইটকেন বলেন, 'এ মুহুর্তে যাত্রীদের বিশ্বাস ও চাহিদার কোনো কমতি দেখছি না আমরা। স্কাইস্ক্যানার প্ল্যাটফর্মে পুরো ২০২৩ সাল জুড়ে ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য চাহিদা দেখা যাচ্ছে।'

সামনের প্রান্তিকগুলোতে চীন থেকে বহির্গামী উড়োজাহাজের সক্ষমতা আরও বাড়বে বলে বিশ্বাস করেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। ফলে এই রুটগুলোতে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাবে।

কোয়ান্টাস এবং এর সাশ্রয়ী সহযোগী এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান জেটস্টার এ বছর আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ১০ লাখ আসনে মূল্য ছাড়ের ঘোষণা করেছে।

জাপান এয়ারলাইন্সও টিকিটে ছাড় দিয়েছে। এ মাসের শুরুতে ছাড় ঘোষণার পর ব্যবহারকারীদের বাড়তি চাপে এয়ারলাইন্সটির ওয়েবসাইট ক্র‌্যাশ করেছিল। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, যাত্রী চাহিদা প্রবল।

তবে সব রুটের উড়োজাহাজের টিকিটের দামই যে বাড়তির দিকে, তা নয়। এইটকেন বলেন, যাত্রীরা যদি গন্তব্য ও তারিখ নিয়ে নমনীয় হতে পারেন, তাহলে সাশ্রয়ী মূল্যে টিকিট কিনতে পারবেন।

তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে ভিয়েতনাম অথবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মালয়েশিয়ার টিকিটের দাম এ বছরের আরও পরের দিকে গত বছরের তুলনায় কম থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যাত্রার বেশ খানিকটা সময় আগে টিকিট কাটলে ভালো দাম পাওয়া যাবে।

সূত্র: সিএনএন

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

8h ago