নাসির উদ্দীন ইউসুফের খোলা চিঠি

বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে কামাল বায়জীদকে অপসারণের প্রতিবাদে ফেডারেশন থেকে সদস্য পদ প্রত্যাহার করেছে ঢাকা থিয়েটার।

গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ এ তথ্য জানান।

আজ গণমাধ্যমে পাঠানো নাট্যকর্মী বন্ধুদের কাছে এক খোলা চিঠিতে এই বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।

চিঠিটি নিচে তুলে দেওয়া হলো।

'প্রিয় নাট্যবন্ধু

শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানবেন।

অত্যন্ত বেদনাক্লিষ্ট মন ও মর্মবেদনা নিয়ে আমি আপনাদের কাছে এ পত্র লিখেছি। ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনারা জেনে গেছেন যে গত ২৩ মার্চ ২০২৩, ঢাকা থিয়েটার বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন থেকে সদস্য পদ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

কষ্ট ও বেদনা এ জন্য, যে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার। সেই ঢাকা থিয়েটারকে আজ বাধ্য হয়ে তাদেরই শ্রম ও মেধায় গড়ে ওঠা ফেডারেশন থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিতে হলো। আমি নিজে মর্মাহত এ জন্য যে আমি এই বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল (দুই মেয়াদে) ও পরবর্তীকালে তিন বার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি। এসবই সম্ভব হয়েছে আপনাদের সমর্থন, সহযোগিতা ও ভালোবাসার কারণে আর সেই সংগঠন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত পত্র লিখতে হয়েছে আমাকে স্বহস্তে। এ যেন নিজ পরিবার ছেড়ে আসা। ফেডারশনভুক্ত দলের কর্মীদের বলছি, আপনাদের মতো নাট্যপ্রাণ মানুষের সাহচর্য থেকে নিজেকে ও দলকে বঞ্চিত করা কষ্ট ও বেদনার তো বটেই।

আমার গ্রুপ থিয়েটার চর্চার বয়স ৫১ বছর। আমাদের ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা ও নাট্যচর্চার বয়স ৫০ বছর। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের বয়স ৪১ বছর। আপনাদেরকে নিয়ে ,আপনাদের সাথে নাট্যমঞ্চ ও রাজপথে জীবনের সিংহভাগ সময় কেটে গেছে আমার ও ঢাকা থিয়েটারের। এ সম্পর্ক ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু ফেডারেশনের নির্বাচিত সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়জীদকে কেন্দ্রীয় কমিটি অগঠনতান্ত্রিকভাবে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিলে এবং আমাদের শত অনুরোধে কামাল বায়েজীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বা নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি কর্তৃক অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ নির্ণয় করতে ফেডারেশন অস্বীকৃতি জানালে আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। উপরন্তু আমি জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলের সময় সম্মানিত কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে এ সংকট নিরসনের অনুরোধও জানাই। কেননা কাউন্সিল কামাল বায়েজীদকে সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত করেছে এবং কাউন্সিল ফেডারেশনের সর্বোচ্চ ফোরাম। তারাই পারে যে কোনো নির্বাচিত ব্যক্তিকে অপসারণ করতে বা শাস্তি প্রদান করতে। কিন্তু আমার কোনো কথাই ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ কর্ণপাত করেননি। নিরুপায় হয়ে ঢাকা থিয়েটার ফেডারেশনের অন্যায় আচরণ ও তিন যুগের পরীক্ষিত নাট্যকর্মী কামাল বায়েজীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা রক্ষাকল্পে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বেদনার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। ফেডারেশনের কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষোভ বা দ্বেষ নেই। ঢাকা থিয়েটার সংগঠন হিসাবে আর ফেডারেশনের সাথে যুক্ত থাকবে না এটি মূলকথা।

ফেডারেশন নিয়ে আমাদের যতই আবেগ থাকুক না কেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমাদের আদর্শ। এখন থেকে ফেডারেশনের সাথে আমাদের আর কোনো দ্বন্দ্ব নাই। রাগ বিরাগ নাই। সম্পর্ক নাই।

ঢাকা থিয়েটার মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রণাঙ্গন থেকে ফিরে অস্ত্র সমর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীন দেশকে গড়ে তুলতে মঞ্চকে নতুন রণাঙ্গন হিসাবে বিবেচনায় এনে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এ দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। প্রয়াত নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, ম. হামিদ, সালাহ উদ্দীন জাকি, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমিসহ প্রায় অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে।

বিগত ৫০ বছরে ঢাকা থিয়েটার ঔপনিবেশিক অবলেশমুক্ত স্বাধীন জাতির নিজস্ব নাট্যরীতি ও আঙ্গিক বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এ কর্মযজ্ঞ অব্যাহত থাকবে।

আমাদের পাশে সব সময় আপনাদের পাবো এ প্রত্যাশা আমাদের রয়েছে। আমাদের শিল্প সম্পর্ক জারি থাকবে। শিল্প নিয়ে মতৈক্য ও মতানৈক্য চলমান থাকবে। কিন্তু সাংগঠনিক সম্পর্ক থাকবে না। তাতে আমাদের শিল্প সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই বিনষ্ট হবে না। আমাদের লক্ষ্য এক, কিন্তু পথ ভিন্ন। আমাদের নাট্যান্দোলনের সৌন্দর্য হচ্ছে বহু পথ বহু মত। অর্ধ শতাব্দীর নাট্যচর্চায় বহুমাত্রিক একটি নাট্যসংস্কৃতি ধীরে গড়ে উঠছে আমাদের দেশে, তা যেন চলমান থাকে শুধু এটুকুই চাওয়া।

বাংলাদেশের নাট্যান্দোলনে আমরা আগের মতোই ভূমিকা রাখব। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশের প্রতিটি নাট্যদল, নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মী সকলের মঙ্গল কামনা করি। আপনারা ভালো থাকবেন। যে কোন প্রয়োজনে আপনাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

বাংলা নাটকের জয় হোক। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

ভালোবাসাসহ

নাসির উদ্দীন ইউসুফ

ঢাকা থিয়েটার।'

Comments

The Daily Star  | English

Rohingya influx: 8 years on, repatriation still elusive

Since the repatriation deal was signed with Myanmar in November 2017, Bangladesh tried but failed to send Rohingyas back.

10h ago