‘আর্টিস্ট’ লিটন রান করলেই ‘বিনিয়োগে’ খরচা হয় যার!

Litton Anuragi

একসময় নিয়মিত ট্রলের শিকার হয়ে জেরবার অবস্থা হতো লিটন দাসের। আপত্তিকর নানান ইঙ্গিত এমনকি সাম্প্রদায়িক কটূক্তিও শুনতে হতো তাকে। বাংলাদেশের খেলা হলে সেই লিটনের নামে এখন গ্যালারিতে রব উঠে। লিটনের নিন্দুকের সংখ্যা আপাতত বিলীন, প্রশংসাকারী বাড়ছে বিস্তর। তবে এমন একজন আছেন যিনি লিটনের আজকের সেরা সময়ের আসার অনেক আগে থেকেই তার সমর্থনে নিজের অর্থ খরচ করছেন। তার ভাষায়, 'বিনিয়োগ' করছেন। লিটন রান করলেই বাছাই করা মানুষকে অদ্ভুত সব উপহার দেন তিনি। ইদানীং লিটন নিয়মিত রান করায় তার খরচের মাত্রাও বেড়ে গেছে।

মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় একজন লেখক, পেশায় মানব গবেষক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়ালেখা করে এখন আছেন স্বাধীন পেশায়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই অনুসারী সময় পেলেই নিয়মিত মাঠে গিয়ে খেলা দেখেন। কখনো মাঠে যেতে না পারলে কাজ ফেলে হলেও লিটনের ব্যাটিং দেখতে টিভির সামনে বসে যান তিনি। দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ২০১৭ সাল থেকে লিটনের পেছনে খরচ করছেন,  'আমি লিটনের পেছনে খরচ করা শুরু করেছি ২০১৭ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টটা তে যে ৭০ করল, তখন থেকে খরচ করছি। ওই সময় থেকেই লিটন ভালো খেললে কাউকে না কাউকে খাওয়াতাম, গিফট দিতাম। এরকম করতে করতে ২০২৩ সালের এই পর্যন্ত একদম হিসাব করে রাখিনি কত খরচ করেছি। যখন সেভাবে দরকার করেছি।'

'২০১৭ থেকে ২০২০ সালের করোনার ওই সময়টা ছাড়া এখন পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি গেছে আমার ধারণা। এরচেয়ে কম হবে না, বেশি হতে পারে।'

Litton Das

লিটনের পেছনেই কেন এই খরচ

ভক্তরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য পাগলামো করেন। একটু দেখা করা, একটু কথা বলার সুযোগ পেতে অনেক কিছুই করেন। কিন্তু হিমালয়ের তেমন কোন ইচ্ছা নেই। লিটনের সঙ্গে দেখা করা, ছবি তোলার বিশেষ আগ্রহ তার নেই। এমনকি তিনি নিজেকে প্রথাগত অর্থে লিটনের ভক্তও দাবি করেন না,  'আপনি যদি আমাকে লিটনের ফ্যান মনে করেন তাহলে ভুল ধারণা, কারণ আমার মতন ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের পক্ষে কারো ভক্ত হওয়া সম্ভব না। আমার কাছে লিটনের পারসোনালিটি যে টাইপ সেটা কখনো ক্রিকেটার সুলভ মনে হয় নাই, অ্যাথেলেটসুলভ লাগেনি। এটা নিয়ে ফেসবুকে অনেক লেখালেখিও করেছি। লিটনকে দেখে আমার অনেকটা বইয়ের চরিত্র টাইপ মনে হয়েছে। অনেকটা মিউজিসিয়ান টাইপ ক্যারেক্টার তার মধ্যে আছে। ফলে লিটনের এই স্টাইলটা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল।'

লিটনের খেলার ধরণকে অনেক গ্রেটের চেয়েও আলাদা মনে করেন তিনি, 'ওর যে ব্যাটিংয়ের স্টাইল। ও যখন ব্যাট করে, যখন বলে-ব্যাটে সংযোগ হয়, একটা শব্দ করে। এই শব্দটা আমি আর কোন ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে পাইনি। আমি সেই ছোটবেলা থেকে টেন্ডুলকার, মার্ক ওয়াহ, ব্রায়ান লারা সবার খেলাই দেখেছি। তারা সবাই ব্যাটসম্যান হিসেবে লিটনের চেয়ে অনেক ক্যালিবার সম্পন্ন কোন সন্দেহ নেই। এখনো বিরাট কোহলি বা জো রুট ক্যালিবারের দিক থেকে লিটনের চেয়ে অনেক আগানো। কিন্তু লিটনের যে জিনিসটা ওদের মধ্যে নেই,  ওর যে টাইমিং ও প্লেসমেন্ট যে স্টাইলটা এটা আমি কখনো কোন ব্যাটারের মধ্যে দেখি নাই।'

লিটনের রান প্রতি খরচের পেছনে আরও একটি দর্শন কাজ করে হিমালয়ের,  'লিটনের পেছনে খরচ করার একটা বড় কারণ হচ্ছে, লিটন অনেক সাম্প্রদায়িক নিগ্রহের শিকার হয়েছে মানুষের কাছ থেকে। ও যেহেতু অনলাইনেই বেশি ট্রলের শিকার হচ্ছিল ফলে ওকে যারা পছন্দ করে, আমার এখান থেকেও তারা কিছু ইতিবাচক ভাইব পেতে পারে। সেই জায়গা থেকে লিটনের পেছনে বিনোয়গের ব্যাপার এসেছে।'

'আর দ্বিতীয়ত ওকে আমি মিউজিসিয়ান বা আর্টিস্টের জায়গা থেকে দেখি বেশি। একটা খেলা দেখায় আমার খরচ কতটুকু? হয়ত মাঠে গিয়ে টিকেট কিনে দেখা বা টিভিতে দেখলে ডিশের বিল দেয়া। কিন্তু আর্টিস্টের বা মিউজিসিয়ানের ভেল্যু অনেক বেশি। যেহেতু আমি নিজে বই লিখি। সেজন্য ভেবেছি ওর কপিরাইট বা ইমেজ রাইটে আমার আরও খরচ করা উচিত। সেই সঙ্গে ও যেহেতু আমার বইয়ের চরিত্র। বইয়ের চরিত্র হওয়ায় ও যেভাবে আমাকে উৎসাহ দেয় বা চিন্তাগুলো দেয় সেটার জন্যও খরচ করা উচিত। লিটনের আগে সাকিবকে নিয়ে আমি প্রচুর লিখেছি। কিন্তু সাকিবের জন্য এত পাগলামো আমার হয়নি যেটা লিটনের জন্য হয়েছে।'

অদ্ভুত সব উপহার

তার উপহারের ধরণও বেশ অদ্ভুত। উপহার তালিকায় থাকে হাঁস, মুরগি, চিতল মাছ, গলদা চিংড়ি, টি-শার্ট, আড়ংয়ের পাঞ্জাবি, ব্যুফে লাঞ্চ, জিলাপি, বই, তরমুজ, ডাব, আনারস, নাশপতি, কবুতর, শার্ট, জুতা, কমলা, ঘড়ি, গাছ ইত্যাদি। উপহার তিনি দেনও মৌলিক সংখ্যার হিসেবে। ধরা যাক কাউকে দিলেন তিনটা হাঁস বা পাঁচটা আনারস কিংবা দুইটা বই। এই ব্যাপারে আছে তার আলাদা ব্যাখ্যা,  'মৌলিক সংখ্যার প্রতি আমার অবসেশন আছে। আমার যে যমজ কন্যা তাদের নামও মৌলিক সংখ্যা। ঊনিশ ও তেইশ। মৌলিক সংখ্যা আমি ছোটবেলা থেকে পছন্দ করি।'

এমন 'পাগলামো' নিশ্চিতভাবেই অনুমোদন করে না হিমালয়ের পরিবার। বাড়তি এসব খরচ তিনি তবু চালিয়ে যাচ্ছেন এক ধরণের আচার পালনের জায়গা থেকে,   'পরিবারের কাছ থেকে এসব কাজে আমি কোন উৎসাহ পাই না। এই নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার প্রায়ই কনফ্লিক্ট বাধে। দেখা যাচ্ছে লিটনের কোন একটা পারফরম্যান্সের কারণে চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে ফেললাম, সেই টাকাটা তো পরিবারের কোন একটা বাজেট থেকে সেক্রিফাইস হয়। এটা নিয়ে তো তাদের মধ্যে একটা অভিযোগ থাকেই যে, "লিটন খেলে লাখ লাখ, কোটি টাকা আয় করছে আমাকে চিনেও না। তার পেছনে এই ধরণের খরচ করে আমরা কেন সাফার করব।" তাদের কথা হয়ত বৈষয়িক দিক থেকে যৌক্তিক। কিন্তু আমি বৈষয়িক দিক থেকে দেখি না। আমার একটা আলাদা ইমাজিনারি ও স্পিরিচুয়াল জগত আছে। সেই জগত আমাকে বলে লিটনের মতোন ছেলেপেলের পেছনে খরচ করা উচিত।'

'আমি একটা নির্দিষ্ট আচার অনুসরণ করি। সেই আচার হচ্ছে উপহার দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। আমি এটাকে রিলিজিয়াসলি ফলো করি। এই জিনিসটাকে আমি বলি কানেক্টিভিটি রিলিজিওন।'

কাদেরকে উপহার 

মূলত ফেসবুকে যারা ইতিবাচক লেখালেখি করেন তাদেরকে বেছে উপহার দেন হিমালয়। এখন কিছু ক্রাইটেরিয়া বদল করেছেন। আয়ারল্যান্ড সিরিজে লিটন অন্তত দুটি ফিফটি করলে তিনি যতগুলো বাউন্ডারি মেরেছেন ততগুলো বই মানুষকে উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন এই ক্রিকেট অনুসারি। লিটনের দুই ফিফটির পর উপহার পেতে যাচ্ছেন বেশ কয়েকজন।

সেই ক্রাইটেরিয়া ঠিক হয়েছে ভিন্নভাবে।  নাজমুল শান্ত, আফিফ হোসেন, শামীম পাটোয়ারি, হাসান মাহমুদ-এই চার ক্রিকেটারকে নিয়ে  বর্তমান ইম্প্রেশন এবং ২০২৫ এর ৭ নভেম্বরের পরে এদের ক্যারিয়ার গতি  কি হবে সেটা নিয়ে অনুমান করা ছিল টাস্ক। যাদের যাদের পর্যবেক্ষণ ভালো লাগবে তাদেরকে উপহার দিবেন হিমালয়।

Litton Das
ছবি: ফিরোজ আহমেদ/ স্টার

এই ধারা কি চলতেই থাকবে?

লিটন যতদিন খেলবেন ততদিনই এমন উপহার দিতে চান হিমালয়। তবে লিটন যদি একটা সময় গিয়ে দলের বোঝা হয়েও জায়গা ছাড়তে না চান, তবে তার পেছনে এই 'বিনিয়োগ' বন্ধ করে দেবেন তিনি।  খেলা ছাড়ার পর হয়ত আজকের প্রাসঙ্গিকতা হারাবেন লিটন। হিমালয় মনে করেন লেখক হিসেবে তখনো প্রাসঙ্গিক থেকে যাবেন তিনি। তার মতে, লিটন যেহেতু তার লেখালেখির একটা চরিত্র, এই ব্যাপারটা তাই লেখকের মোরাল কমিটমেন্ট পয়েন্টে দেখা উচিত।

Comments

The Daily Star  | English
eid-ul-azha emergency cases at pongu hospital

An Eid evening at Pongu Hospital: overflowing emergency, lingering waits

The hospital, formally known as NITOR, is a 1,000-bed tertiary medical facility that receives referral patients from all over the country

2h ago