২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে যে প্রভাব পড়বে
বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন নীতি যদি চলমান থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাপী কয়েক কোটি মানুষ প্রাণঘাতী উচ্চ তাপমাত্রা মুখোমুখি হবে। তবে বিশ্বব্যাপী হিট অফিসারদের একটি নেটওয়ার্ক তাদের নিজ নিজ শহরগুলোতে তাপমাত্রা সংক্রান্ত সমস্যাটি মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন।
ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেচার সাসটেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত নতুন গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমান জলবায়ু পরিস্থিতি যদি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে, তাহলে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রায় ২০০ কোটি মানুষ বিপজ্জনক উষ্ণ পরিস্থিতিতে বাস করবে। যা হবে আনুমানিক বৈশ্বিক জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ।
যদি জলবায়ুর উষ্ণতা আরও তীব্র হয়- বর্তমান পরিস্থিতিতে যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলো প্রায় ৩৩০ কোটি মানুষ এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ চরম তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার এবং চীনের নানজিং ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, ৬ কোটি মানুষ ইতোমধ্যে বিপজ্জনক তাপমাত্রার ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। সাধারণত ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৮৪.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এর অধিক তাপমাত্রাকে বিপজ্জনক তাপমাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
গরম তাপমাত্রা যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে প্রচণ্ড গরমের ফলে হিটস্ট্রোক ও হাইপোথার্মিয়ার মতো নানা অসুস্থতা দেখা দিতে পারে এমনকি মুত্যুও ঘটতে পারে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা শরীরে দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে।
বয়স্ক, শিশু, গর্ভবতী নারী, বাইরে কাজ করে এমন কর্মী, ক্রীড়াবিদ এবং দরিদ্ররা উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, প্যারিস শান্তি চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেও যদি তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তাহলেও শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী অন্তত ৪০ কোটি মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়বে।
তাপমাত্রা এমনকি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াল বৃদ্ধি পেলেও ভারত, সুদান ও নাইজারের মানুষ চরম বিপদে পড়বে। আর তাপমাত্রা যদি ২.৭ ডিগ্রি বাড়ে, তাহলে ফিলিপাইন, পাকিস্তান ও নাইরেজিয়ার মতো দেশগুলোর মানুষ অকল্পনীয় ঝুঁকির মুখে পড়বে।
মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের যে দায় মেটাচ্ছে
গবেষকরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের শুধু অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করার যে ধারা, তারা তা ভেঙে দিয়েছেন। তারা সম্ভাব্য মানবিক সংকটের ব্যাপারটিও সামনে নিয়ে এসেছেন।
জলবায়ু কর্মী ও গবেষণাপত্রটির সহ-লেখক আশিষ ঘাদিয়ালি বলেছেন, যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিমাপে মডেল তৈরি করা হয়, তখন নিউইয়র্কের মতো ধনী এলাকায় বসবাসকারীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় আর বাংলাদেশের মতো গরীব অঞ্চলের মানুষদের কম প্রাধান্য দেওয়া হয়।
এর কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক মডেলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত মানবিক সংকটের চেয়ে মানুষের জীবনের আর্থিক মূল্যের দিকটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
অন্যান্য বেশিরভাগ মডেলেও ভবিষ্যতের তুলনায় বর্তমান জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
ঘাদিয়ালি বলেন, 'এটা (জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ক মডেল) আমার সন্তানের চেয়ে এবং অবশ্যই আমার নানি-নাতনীতদের জীবনের চেয়ে আমার জীবনকে বেশি গুরুত্ব দেয়।'
যদি পৃথকভাবে দেশগুলোর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়, তাহলেও দেখা যাবে যুক্তারষ্ট্রের একজন নাগরিকের গড় কার্বন নিঃসরণ (১.২) ভবিষ্যত জনগোষ্ঠকে তীব্র তাপমাত্রায় বসবাস করার ঝুঁকিতে ফলেছে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ নির্গমন সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বিপজ্জনক তাপমাত্রার ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি কম মোকাবিলা করছে।
পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতেও দেখা গেছে, 'হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট'-এর কারণে বিশ্বের অনেক শহর তাপমাত্রা বৃদ্ধির মারাত্মক ঝুঁকির মুখে আছে। ভবন, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো, প্রাকৃতিক পরিবেশের (বন ও নদীনালা) তুলনায় সূর্যের তাপ বেশি শোষণ করার ফলে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে অন্তত ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়ায় বেশি থাকে।
শহরাঞ্চলের এই বাড়তি তাপমাত্রা মোকাবিলার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহরের কর্তৃপক্ষ 'চিফ হিট অফিসার' নিয়োগ দিচ্ছে। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ক্রিস্টিনা হুইদোব্রো। ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর চিফ হিট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে হুইদোব্রো বলেন, 'বিশ্বের অনেক শহর তীব্র তাপমাত্রা মোকাবিলা করছে। কিন্ত এর সমাধান কিংবা এই সমস্যা মোকাবিলায় আপনি কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা স্থানীয় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।'
হুইদোব্রো বলেন, 'তারপরও মোটের ওপর ৩টি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন তারা- প্রস্তুতি, জনসচেতনতা ও অভিযোজন।
প্রস্তুতির মধ্যে থাকতে পারে- দাবদাহকে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই মোকাবিলা করা এবং তাপমাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছালে শহর কর্তৃপক্ষ কী কী ব্যবস্থা নেবে, তা নির্ধারণ করা।
সান্তিয়াগো শহরের চিফ হিট অফিসার মনে করেন, অতিরিক্ত গরম পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, 'প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খুব সহজেই নিজের যত্ন নেওয়া সম্ভব। বেশি করে পানি পান করুন, ছায়ার মধ্যে থাকুন আর বিশ্রাম নিন। অতিরিক্ত গরমে কাউকে মরতে হবে না।'
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে শহরকে অতিরিক্ত তাপমাত্রা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা। শহরের মধ্যে আরও বেশি গাছ লাগিয়ে এটা করা যেতে পারে।
সান্তিয়াগো শহরজুড়ে সম্প্রতি ৩০ হাজার গাছ লাগানোর একটি প্রকল্প চালু হয়েছে এবং গাছকে শহুরে অবকাঠামোর অংশ হিসেবে বিবেচনা করার কৌশল গৃহীত হয়েছে।
'শুধু গাছ, গাছ আর গাছ। এগুলো শহরকে আরও সবুজ করে তুলবে,' হুইদোব্রো বলেন।
তবে বৃক্ষরোপণকে মানুষ যত সহজ মনে করে, এটা ততটা সহজ নয়।
'আমরা প্রচণ্ড ব্যস্ত রাস্তায় গাছ লাগাচ্ছি। যেমন- শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে, যেখানে প্রচুর সিমেন্ট রয়েছে। গাছ লাগানোর জন্য সেখানে গর্ত খুঁড়তে হবে এবং মোটামুটি ভালো কাজ করতে হবে।'
এই উদ্যোগ তাৎক্ষণিক ফলাফলও দেবে না।
'এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আগামী ২০-৩০ বছর পর যাতে আমরা পর্যাপ্ত ছায়া পাই,' হুইদোব্রো বলেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও সম্প্রতি একজন চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দিয়েছে। তার নাম বুশরা আফরিন। তিনি এশিয়ারও প্রথম চিফ হিট অফিসার।
যুক্তরাষ্ট্রের যে শহরগুলো তীব্র তাপমাত্রার বিরুদ্ধে লড়াই করছে
যুক্তারষ্ট্রে প্রতিবছর দাবদাহে ১২ হাজার মানুষ মারা যায়। দেশটির ফিনিক্স, মিয়ামি এবং লস অ্যাঞ্জেলেস কর্তৃপক্ষ চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দিয়েছে।
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরটি দাবদাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। শহরটির কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা কমিউনিটিগুলোতে ছায়া ও শীতলীকরণ সুবিধা সমৃদ্ধ 'রেজিলিয়েন্স হাব' তৈরির জন্য প্রচারাভিযান শুরু করেছে। শহরটিতে এখনই বিভিন্ন কুলিং সেন্টার আছে (অধিকাংশই বিভিন্ন লাইব্রেরিতে), যেখানে মানুষ অতিরিক্ত গরমে আশ্রয় নিতে পারে।
শহরের কর্তৃপক্ষ দাবদাহের সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা নিয়েও কাজ করছে।
ফিনিক্স শহরের কর্তৃপক্ষও তাপমাত্রা মোকাবিলায় শীতল ফুটপাত তৈরির মতো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
ফ্লোরিডার মিয়ামি শহরের কর্তৃপক্ষ শহরজুড়ে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে। এ ছাড়া শহর কর্তৃপক্ষ নিম্ন আয়ের মানুষদের বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকির পাশাপাশি আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের জন্য এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা নিশ্চিতে লাখ লাখ ডলাার ব্যয় করেছে।
তবে সান্তিয়াগোর হুইদোব্রো বলেন, জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা সাধারণত অভিযোজনের শেষ উপায়।
সান্তিয়াগো শহরে ৩৩টি 'পকেট ফরেস্ট' স্থাপন করতে চান হুইদোব্রো যা জলবায়ু আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং এগুলো হবে স্কুল এবং হাসপাতালের কাছাকাছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কুলিং সেন্টারগুলোর বিকল্প হিসেবে কাজ করবে এই পকেট ফরেস্টগুলো।
'দাবদাহের সময় মানুষ এসব প্রাকৃতিক কুলিং সেন্টারে আশ্রয় নিতে পারবে, বিশ্রাম নিতে পারবে,' বলেন হুইদোব্রো।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল
Comments