‘মহীশূরের বাঘ’ টিপুর তরবারি কেন এত দামি

টিপু সুলতান, তরবারি, মহীশূর,
টিপু সুলতানের সেই তরবারি। ছবি: বোনহ্যামস

আমরা যতই আধুনিকতার স্রোতে ভেসে যাই না কেন, ইতিহাসের প্রাচীন গন্ধ এখনো রহস্য নিয়ে আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। কখনো কখনো বহু পুরোনো কোনো গল্প বাঁক নেয় নতুন মোড়ে, ধরা দেয় কোনো নতুন মোড়কে। শের-ই-মহীশূর তথা টিপু সুলতানের একটি তরবারিও সেভাবেই পুরোনো গল্পের অলি-গলি পেরিয়ে সম্প্রতি একটি নিলামের বদৌলতে নতুন মোড়কে উপস্থাপিত হয়েছে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তখনো সূর্য অস্ত যেতে শেখেনি। তখনো ভারত-বিহার-উড়িষ্যা-বাংলার মাটি কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ইংরেজদের বুটের গটগট আওয়াজ। তখন হাতেগোণা কয়েকজন সময়ে সময়ে ইংরেজ দখলদারিত্ব থেকে উপনিবেশকে রক্ষার পণ করেন। তাদের মধ্যে মহীশূরের এই শাসনকর্তা অন্যতম। ইতিহাসের পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করে টিপু সুলতান ও তার তরবারি 'দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান'। ধরে নেওয়া হয় ইংরেজদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনচেতা মনোভাবের শেষ হাতিয়ার ছিল এটি।

 ‘মহীশূরের বাঘ’ টিপুর তরবারি কেন এত দামি
টিপু সুলতানের তরবারি। ছবি: বোনহ্যামস

আর তাই এত বছর পরও নিলামে উঠে মঞ্চ কাঁপিয়ে দেওয়ার শক্তি এর মধ্যে আছে। আজ পর্যন্ত নিলামে ওঠা ভারতীয় বস্তুর তালিকার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এটি। যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেই ব্রিটিশ মুদ্রাতেই এখন এর মূল্য ছাড়িয়ে যায় ১৪ মিলিয়নেরও বেশি, ভারতীয় রুপিতে যা ১৪৩ কোটির কাছাকাছি। এই নিলাম হয় লন্ডনে, ইসলামিক অ্যান্ড ইন্ডিয়ান আর্ট সেল সপ্তাহে। বোনহ্যামস নামক নিলাম ঘরে এই ইতিহাস পরবর্তী ইতিহাস রচিত হয়। কিন্তু, বোনহ্যামস কীভাবে এই তরবারির খোঁজ পেল, সে কথা তারা খোলাসা করেনি। এমনকি এমন তত্ত্বেরও উদয় হচ্ছে যে, বেয়ার্ড পরিবার আদতে টিপু সুলতানের দুখানা তরবারি বাগিয়ে নিতে পেরেছিল। তবে এমনটা ঘটে থাকলেও সেই দ্বিতীয় তরবারির কথা জানা যায় না, সেটির শান-শৌকত এটির মতো উজ্জ্বল নয় বলেই হয়তো।

টিপু সুলতানের নাম নিলেই যে নামটি সবার আগে মাথায় আসে, তা কোনো ব্যক্তির নয়– একটি প্রাণহীন, প্রাণকাড়া তলোয়ারের। যে নামে লেখা হয়েছে বই, মঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে নাটক। নব্বই দশকে ভারতের দূরদর্শন চ্যানেলে সম্প্রচারিত 'সোর্ড অব টিপু সুলতান' ধারাবাহিক ইতিহাসকে এবং বিশেষত টিপু সুলতান ও তার তরবারিটি এ অঞ্চলের মানুষের কাছে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলে।

 ‘মহীশূরের বাঘ’ টিপুর তরবারি কেন এত দামি
ছবি: বোনহ্যামস

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ব্যবহারকারীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ আছে, ইতিহাসে থাকা এমন অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে এই তরবারিটি অন্যতম গুরুত্ব বহন করে। ১৭৯৯ সালের ৪ মে টিপু সুলতানের মৃত্যুর দিন বহু হাতিয়ারই পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যে এই তরবারিটির স্থান ছিল সবচাইতে বিশেষ। আর এত বিশেষ বলেই নিলামে হাঁকা মূল্য সবার চক্ষু চড়কগাছ করে দিতে সক্ষম।

বলা হয়ে থাকে, টিপু সুলতানের সঙ্গে সংযোগের হিসাব ছাড়াও এই হাতিয়ারটি নিজেই অনেক বিশেষ। এতে থাকা ইস্পাত শক্তিশালী শাসকেরই প্রতীক। কোফতগাড়ি শিল্পে খচিত এই তলোয়ারটিকে ডাকা হয় 'সুখেলা', এক কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে। কোফতগাড়ি শিল্পের সূচনা এই দক্ষিণ এশিয়াতেই। মূলত ইস্পাতের ওপর স্বর্ণের কারুকাজ অস্ত্রকে আরও বেশি মূল্যবান করে তোলে। সেই ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানদের অনুকরণে মোঘল তলোয়ার নির্মাতারা এটি তৈরি করেন। স্বর্ণের কারুকাজে এতে ক্যালিগ্রাফি করা আছে বিভিন্ন প্রার্থনাবাক্য ও স্রষ্টার নাম। কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে এতে প্রার্থনার শক্তি মিলে যেন মুক্তির দাবিকে আরও বেশি আবেগী, আরও বেশি স্মরণীয় করে তোলে। এত বছর পরে বসেও পুরনো তরবারির ঝিকিমিকিতে ঝলসে ওঠে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাস। আর তাই এর মূল্য আকাশচুম্বী হবে, তাতে সন্দেহ কী!

 ‘মহীশূরের বাঘ’ টিপুর তরবারি কেন এত দামি
সম্প্রতি একটি নিলামে রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে তরবারিটি। ছবি: বোনহ্যামস

মৃত্যুর পর টিপু সুলতানের ব্যক্তিগত কক্ষে এই তরবারিটি পাওয়া গিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকদের কাছে পরিচিত 'টিপু সাহেব' যখন মারা গেলেন, তখন সাহসিকতার উপহার হিসেবে এটি গিয়ে পৌঁছলো ব্রিটিশ মেজর জেনারেল ডেভিড বেয়ারডের কাছে। প্রথমদিকে, অর্থাৎ প্রথম ২০৪ বছর এই তরবারি ছিল বেয়ারড পরিবারের কাছে। ২০০৩ সালে প্রথম এটি নিলাম ঘরে তোলা হয়। সে বছরই ভারতীয় ব্যবসায়ী বিজয় মাল্য সেটি কিনে নেন। ২০ বছর পর, তিনি সেটি ১৪৩ কোটি ভারতীয় রুপিতে বিক্রি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রেতার কাছে। ইতিহাসের এত বিশেষ একটি নিদর্শন ঠিক কার সংগ্রহে থাকবে, কার ড্রয়িংরুমে অতিথিদের সঙ্গে সান্ধ্যকালীন চায়ের আড্ডার খোরাক হবে– সেটিও এখন ইতিহাসের মতোই রহস্যময়।

তথ্যসূত্র–

টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইকোনমিক টাইমস, হিস্টোরি টুডে

Comments

The Daily Star  | English

Crores spent, but Ctg roads still crumble

Commuters in Chattogram are enduring severe hardships due to the appalling condition of major roads, a crisis worsened by the apparent indifference of the authorities.

6h ago