‘আড়াইহাজারের ১২ যুবক মিয়ানমার কারাগারে’, ফিরিয়ে আনার আবেদন পরিবারের

ইউএনও জানান, যদি তারা মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি থাকেন তাহলে সরকারিভাবে যে প্রক্রিয়ায় তাদের ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যবস্থা করা হবে।’
আড়াইহাজার মানবপাচার
গত ১০ জুলাই আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান ভুক্তভোগী ১২ যুবকের পরিবারের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

পরিবারের কাউকে না জানিয়ে গত ১৯ মার্চ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ২৮ বছর বয়সী সাফায়েত হোসেন৷ দুদিন খোঁজাখুজির পর বাবা ইসহাক মিয়া জানতে পারেন 'দালালের খপ্পরে' পড়ে নৌপথে মালয়েশিয়া রওয়ানা হয়েছে তার ছেলে। তার কিছুদিন পর ইসহাক জানতে পারেন, পথে মিয়ানমার আটক হয়েছে তার ছেলেসহ ১২ জন, কোনো এক কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে।

সাফায়েতের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী ইউনিয়নের চৈতনকান্দা গ্রামে।স্থানীয় একটি পাওয়ারলুম (তাঁত) কারখানায় কাজ করতেন।

সাফায়েতসহ বিশনন্দী ইউনিয়নের আরও ১১ যুবক দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে আটক হয়ে মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি বলে দাবি ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের।

অন্যরা হলেন- মানিকপুর গ্রামের হোসেন মিয়ার ছেলে মো. নাদিম (৩৫), চৈতনকান্দা গ্রামের হেলাল উদ্দিনের ছেলে রতন মিয়া (২৭), একই গ্রামের মো. হাকিমের ছেলে আছান (৪৮), উলুকান্দি গ্রামের নূর আলামিনের ছেলে মো. মনির হোসেন (২১), বিশনন্দী গ্রামের নুরুল ইসলামের মো. সজীব (২১), একই গ্রামের আবেদ আলীর ছেলে কবির হোসেন (৩৭), শরিফপুর গ্রামের মাজু মিয়ার ছেলে মো. জুয়েল (২৪), কড়ইতলা গ্রামের খোরশেদ আলমের ছেলে মো. বিল্লাল হোসেন (১৯), বিশনন্দী পশ্চিমপাড়ার মো. ডালিমের ছেলে মো. সজীব (২০), চৈতনকান্দার গ্রামের বাচ্চু মিয়ার ছেলে মো. সফিকুল (৩৯) এবং একই গ্রামের আমির আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (২৫)৷

ভুক্তভোগী এই ১২ যুবকের পরিবারের সদস্যরা গত ১০ জুলাই আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান৷ তারা তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানান৷

পরিবারগুলোর অভিযোগ, স্থানীয় একটি দালালচক্রের প্রলোভনে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য নৌপথে রওয়ানা দিয়ে মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি ১২ যুবক৷ তাদের সেখানে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে৷ মিয়ানমারে আটক থাকা যুবকরা স্বজনদের ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন বলেও তাদের কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা৷

পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে দালালচক্রের তিন জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- ইসমাইল, জসিমউদ্দিন ও আবুল৷ তাদের বাড়িও বিশনন্দী ইউনিয়নে৷ তবে গত কয়েক মাস যাবৎ ইসমাইল ও আবুলের কোনো খোঁজ নেই৷ এদিকে গত ১৫ এপ্রিল মানবপাচারের অভিযোগে এক মামলায় গ্রেপ্তার হন আবুল৷

প্রায় চার মাস ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা দিনমজুর ইসহাক মিয়া। তিনি বলেন, 'রোজা (রমজান মাস) শুরু হওয়ার তিন দিন আগে বাড়ি ছাড়ছে সাফায়েত৷ কোথায় গেছে কিছু কইয়া যায় নাই৷ মাঝে মাঝে জোগালির (রাজমিস্ত্রি) কাজে ঢাকা যায়৷ এবারও ঢাকা গেছে ভাবছি৷ কিন্তু দুইদিন গেছে, কোনো খোঁজ না পাইয়া ওর বন্ধুবান্ধবের লগে কথা কইয়া জানলাম, দালালের খপ্পরে পইড়া মালয়েশিয়া যাওয়ার লাইগা রওনা হইছে৷ এরও ১৫-২০ দিন পর পোলায় তার বন্ধু মোবাইলে ভয়েস দিয়া জানাইসে, "শিপে যাবার সময় পোলায় বার্মা আটকা পড়ছে৷"'

'এরপর থেইকা আর কিছু জানি না৷ পোলায় বাঁইচা আগে নাকি মইরা গেছে তারও কোনো খোঁজ পাইতেছি না৷ আমি আমার পোলারে ফিইরা পাইতে চাই,' কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন ইসহাক৷

স্বামীর খোঁজ না পেয়ে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে হাসনারার। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'বাড়ি ছাড়ার পর কোনো খোঁজ নাই৷ দালাল ইসমাইলরে ফোন দিলেও সে ধরে না৷ দুই মাস ইমোতে কল দিলে ধইরা কয়, যাওয়ার সময় মায়ানমার আটকা পড়ছে৷ ১৫ হাজার টাকা দিলে কথা কওয়াইয়া দিবো কইছিল ইসমাইল৷ আমরা কথা কওয়াইয়া দিলে ৫ হাজার টাকা দিমু কইছিলাম৷ এরপর ইসমাইল কল কাইট্টা দেয়৷ পরে আবার আমি কল দিলে ইসমাইল কয়, অ্যাম্বাসি গেলে আমার স্বামীরে ফিইরা পামু৷ দেড়মাস ধইরা ইসমাইল আর কল ধরে না৷'

নাদিমের শ্যালক মাসুম বিল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আড়াইহাজারে একটি দালালচক্র সক্রিয়৷ তারা মানবপাচারের সাথে যুক্ত৷ এ চক্রের লোকজন গরীব মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে টেকনাফ নিয়ে গিয়ে পাচার করে দেয়৷ তার দুলাভাইর ঘটনার আগেও কয়েকজন পাচারের শিকার হয়েছেন৷ পরে দালালদের মুক্তিপণ দিয়ে কেউ কেউ ছাড়া পেয়েছেন৷ মানবপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে বিশনন্দীর জহিরুল হক নামে এক যুবক মারাও গেছেন৷ নির্যাতনের ভিডিও গ্রামে পরিবারের কাছে পাঠিয়েছিল জহিরুল৷

গ্রামে ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতো মনির হোসেন৷ তিনিও মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি জানিয়েছে পরিবার৷

মনিরের ছোটভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, 'ভাইয়ের কোনো খোঁজ নাই৷ বাড়ির সবাই টেনশনে৷ মা তো ঠিকমতো কিছুই খায় না৷ আমার নানি অসুস্থ মানুষ, তার শরীর টেনশনে আরও খারাপ হয়ে যাইতেছে৷'

বিল্লাল হোসেনের মা সেলিনা বেগম বলেন, 'আমার ছেলেরে মিয়ানমারে আটকে রাইখা অনেক নির্যাতন করতেছে৷ আমি আমার ছেলেরে মুক্ত কইরা আনতে চাই৷ সরকার যেন কিছু একটা করে তাগোরে ফিরাইয়া আনতে৷'

জানতে চাইলে বিশনন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোরবানির ঈদের কয়েকদিন আগে বিষয়টি আমারে পরিবারের লোকজন জানিয়েছিল৷ গরীব মানুষ দালালের খপ্পরে পড়ছে৷ আমরা সবসময় গ্রামবাসীরে বলি, ছেলেরা কে, কোথায় যায় সেই খোঁজ রাখার জন্য৷ বিভিন্ন সময় কাউন্সিলিং প্রোগ্রামও করি৷ কিন্তু তারা এইগুলা বুঝতে চায় না৷ আমি মনে করি এই দালালচক্রের লোকগুলারে চিহ্নিত কইরা আইনি আওতায় শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত৷'

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) নামে বেসরকারি সংস্থার আড়াইহাজার উপজেলার ফিল্ড অফিসার আমিনুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সবই নিম্ন আয়ের লোকজন৷ তাদের প্রলোভন দেখানো সহজ৷ বিদেশে ভালো চাকরির আশা দিয়ে দালালচক্রের লোকজন এ কাজ করে৷ স্বজনদের প্রাণনাশের ভয়ে এতদিন মুখ খোলেনি পরিবারগুলো। তারা ভেবেছিল, কাউকে কিছু বললে দালালরা তাদের স্বজনদের ক্ষতি করবে৷ কিন্তু এখন তারা বুঝেছেন, এভাবে হবে না৷ তারা স্বজনদের ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারিভাবে সহযোগিতা চাচ্ছেন৷ আমরা নিখোঁজদের একটা তালিকা করে ইউএনওর সাথে পরিবারগুলোর লোকজনকে নিয়ে কথা বলেছি৷ তিনি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন৷'

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজনের দাবি, নৌপথে অবৈধ প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে মিয়ানমারে আটক হয়ে কারাগারে বন্দি আছেন৷ তারা ১২ জনের নাম নিয়ে গত ১০ জুলাই এসেছিলেন৷ তাদের আবেদনে কিছু সংশোধনী ছিল৷ সংশোধন করে কার্যালয়ে জমা দেওয়ার কথা বলেছি তাদের৷ আমরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। যদি তারা মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি থাকেন তাহলে সরকারিভাবে যে প্রক্রিয়ায় তাদের ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যবস্থা করা হবে।'

Comments