পাটের দাম মণপ্রতি কমেছে ১ হাজার টাকা, আরও কমার আশঙ্কা

রংপুর অঞ্চলের ৭৫ হাজার পাটচাষিকে পাটচাষ করে লোকসান গুণতে হচ্ছে। হতাশ হয়ে অনেকেই আগামীতে পাটচাষ না করার কথা ভাবছেন।
পাটের দাম
লালমনিরহাটের বড়বাড়ী হাটে কৃষক ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

মকবুল হোসেন (৬৫) চলতি বছর ৫ বিঘা জমি থেকে পাটের ফলন পেয়েছেন ৩৫ মণ। তার উৎপাদন খরচ পড়েছে ৮০ হাজার টাকা। স্থানীয় বাজারে প্রতিমণ (৪০ কেজি) পাট ২ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করে পেয়েছেন ৭৭ হাজার টাকা। এ বছর ৫ বিঘা জমিতে পাটচাষ করে তার লোকসান হয়েছে ৩ হাজার টাকা।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা গ্রামের কৃষক মকবুল হোসেনের মতোই রংপুর অঞ্চলের ৭৫ হাজার পাটচাষিকে পাটচাষ করে লোকসান গুণতে হচ্ছে। হতাশ হয়ে অনেকেই আগামীতে পাটচাষ না করার কথা ভাবছেন।

মকবুল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর প্রতিমণ পাট ৩ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। আশা করেছিলাম এ বছর প্রতিমণ পাট ৩ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারব। কিন্তু দর কমে যাওয়ায় এ বছর প্রতিমণ পাট ১ হাজার টাকা কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে।'

'আমার ১২ বিঘা জমির মধ্যে প্রতি বছর ৪-৫ বিঘা জমিতে পাট চাষ করি। কিন্তু আগামী বছর থেকে আর পাট করব না,' বলেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পাট উন্নয়ন অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, এ বছর রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীর মোট ৫২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক পাট চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

 

গত বছর পাট চাষের জমির পরিমান ছিল ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর। সবচেয়ে বেশি পাটচাষ হয় কুড়িগ্রাম জেলায়। এ বছর এ জেলায় পাট চাষ হয়েছে ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে। রংপুর অঞ্চলে এ বছর পাটের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন।

সারাদেশে এবার পাট চাষ হয়েছে ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের কৃষক মফিজুল ইসলাম (৫৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর পাটের দামে খুশি ছিলাম। ভেবেছিলাম এ বছর আর দাম পাব। কিন্তু এ বছর উৎপাদন খরচও তুলতে না পারিনি।'

তিনি জানান, গত বছর ৬ বিঘা জমিতে পাট চাষ করলেও, এ বছর করেছেন ৮ বিঘা জমিতে। প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা খরচ করে ৮ বিঘা জমিতে ৬৩ মণ পাট উৎপাদন করেছেন। স্থানীয় যাত্রাপুর হাটে প্রতিমণ পাট ২ হাজার ৩০০ টাকা দরে ৬৩ মণ পাট ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে তার লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ১০০ টাকা।

বীজ, সার, কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি আর শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবিঘা জমিতে পাট উৎপাদনে ১৫-১৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে তিনি জানান।

মফিজুল বলেন, 'ব্যবসায়ীরা আমাদের বলছেন যে এ বছর বিদেশে নাকি পাট যাচ্ছে না। আমি আগামীতে পাট চাষ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার চর কোদালকাটি গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম মন্ডল (৬৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গ্রামের অধিকাংশ কৃষকই পাট চাষ করে থাকেন। কিন্তু এ বছর পাটের বাজার দর কম হওয়ায় তারা পাটে লোকসান গুণছেন। চরম হতাশায় পড়েছেন কৃষকরা।'

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর হাটের পাট ব্যবসায়ী খবির উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি সপ্তাহে যাত্রাপুর হাটে প্রায় ৬-৭ হাজার মণ পাট কেনাবেচা হয়ে থাকে। বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এই হাটে আসেন পাট কেনার জন্য। এ বছর পাটের দর কম হওয়ায় কৃষকরা পাট বিক্রি করার সময় হতাশায় ভুগছেন।'

'অনেক কৃষক কম দামে পাট বিক্রি করতে অনীহা প্রকাশ করেন। অনেক সময় পাটের দর নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটছে। আমি কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনে গুদামজাত করে রাখছি। জানিনা বিক্রি করতে পারব কিনা,' বলেন তিনি।

এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, 'পাটের বড় পাইকাররা এখনো আমাদের কাছ থেকে পাট কিনছেন না। তারা আমাদের জানিয়েছেন এ বছর বিদেশে পাট রপ্তানি হচ্ছে না। আমার ধারণা দর আরও কমতে পারে।'

রংপুর শহরের পাট ব্যবসায়ী সুপেন চন্দ্র সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বর্তমানে তারা প্রতি মণ পাট ২১০০-২৩০০ টাকা দরে কিনছেন। বিদেশে পাট যাচ্ছে না তাই তারা পাট কিনে গুদামজাত করে রাখছেন। কৃষকদের কাছ থেকে কেনা পাট তারা জুটমিলে বিক্রি করতে পারবেন কি না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তিনি বলেন, 'গত বছর কৃষকদের কাছ থেকে প্রতিমণ পাট ৩০০০-৩২০০ টাকা দরে কিনেছিলাম। বিদেশে পাট রপ্তানি হওয়ায় লাভবানও হয়েছিলাম। এ বছর আমি ৫ হাজার মেট্রিক টন পাট কেনার প্রস্তুতি নিয়েছি। গত বছর কিনেছিলাম ৭ হাজার মেট্রিক টন।'

যোগাযোগ করা হলে কুড়িগ্রাম জেলার মুখ্য পাট পরিদর্শক ফিরোজ মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর পাটের দাম আশানুরুপ পাওয়ায় কৃষকরা এ বছর বেশি জমিতে পাট চাষ করেছেন। তবে পাটের বর্তমান বাজার দরে কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেক কৃষক পাট বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না।'

তিনি আরও বলেন, 'বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে দেশের বাইরে পাটের চাহিদা কম হওয়ায়, দেশের বাজারে পাটের দামের ওপর চরম প্রভাব পড়েছে। এ পরিস্থিতি কাটবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না'।

জানতে চাইলে লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর কৃষকর পাটের ফলন ভালো পেলেও বাজার দর নিয়ে হতাশায় আছেন। উৎপাদন খরচ তুলতে না পারায় অনেক কৃষক পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আগামীতে পাট চাষ অর্ধেকে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago