‘কোয়ান্টাম ডট’ আবিষ্কারে রসায়নে নোবেল, প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশও

রসায়নে নোবেলজয়ী মুঙ্গি বাওয়েন্ডি (বামে), লুই ব্রুস (মাঝে) ও আলেক্সি ইয়াকিমভ (ডানে)। ছবি: নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

টেলিভিশন, এলইডি বাল্বের মতো ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরি থেকে শুরু করে শরীরের ভেতরে অতিসূক্ষ্ম টিউমার অপসারণে ন্যানোপ্রযুক্তি বা অতিসূক্ষ্ম প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। ন্যানোপ্রযুক্তি বা ন্যানোটেকনোলজি হলো পদার্থ বা বস্তুকে অণু পর্যায়ে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি। 

ন্যানোপ্রযুক্তিতে আগে ব্যবহার হতো ১০০ ন্যানোমিটার আকৃতির বস্তুকণা, যেখানে ১ ন্যানোমিটার হলো ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ।

এই প্রযুক্তিকে আরও এগিয়ে নিতে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৭ ন্যানোমিটার আকৃতির 'ন্যানোক্রিস্টাল' বা 'কোয়ান্টাম ডট' উদ্ভাবনের স্বীকৃতি হিসেবে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩ বিজ্ঞানীকে এ বছরের রসায়নে নোবেল দেওয়া হয়েছে।

নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীরা সিলিকনজাতীয় অর্ধপরিবাহী পদার্থ দ্বারা ন্যানোস্কেলের (২-৭ ন্যানোমিটার) পারমাণবিক বা আণবিক কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যাকে বলা হচ্ছে 'কোয়ান্টাম ডট'।

প্রকৃতপক্ষে, যখন কোনো বস্তুকে ছোট করতে করতে ন্যানো আকারে নেওয়া হয় তখন সেটি 'কোয়ান্টাম' হিসেবে আচরণ করে, যার ভেতরে ওই পদার্থের শক্তি নিহিত থাকে। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা তার মূল পদার্থের তুলনায় অস্বাভাবিক সব বৈশিষ্ট্য দেখায়, যা নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে কাজে লাগানো সম্ভব।

তাদের এই আবিষ্কার ও কোয়ান্টাম ডটের বৈশিষ্ট্য-ব্যবহার নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও দেশে ন্যানোটেকনোলজি নিয়ে কাজ করা গবেষকদের সংগঠন বাংলাদেশ ন্যানো সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ড. আল-নকীব চৌধুরীর সঙ্গে।

তিনি বলেন, 'কোয়ান্টাম ডট নিয়ে বেশ আগে থেকেই কাজ চলছে। এটা এক ধরনের ন্যানো ম্যাটেরিয়াল বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা। দুই থেকে পাঁচ  বা সাত ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্রতম বস্তুকণাই কোয়ান্টাম ডট।'

পৃথিবীর সাপেক্ষে একটি ফুটবলের আকার যত ক্ষুদ্র, একটি ফুটবলের সাপেক্ষে একটি কোয়ান্টাম ডট তত ক্ষুদ্র। ছবি: নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

এই গবেষক বলেন, 'ম্যাটেরিয়ালের আকার ক্ষুদ্রতম অবস্থায় নিয়ে গেলে দেখা যায় যে তার নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ছে। নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারটাই করেছেন। এখন পর্যন্ত আমরা ন্যানোটেকনোলজির যত ধরনের ব্যবহার করেছি, সেগুলোর মধ্যে কোয়ান্টাম ডট বা ন্যানোক্রিস্টালই সর্বোচ্চ শক্তিসম্পন্ন। এগুলো সাধারণত সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধ-পরিবাহী ম্যাটেরিয়াল দিয়েই তৈরি হয়।' 

এই প্রযুক্তি ট্রানজিস্টার, সৌরকোষ, ডায়োড লেজারে এবং কৃষি, পদার্থ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে মেডিক্যাল ইমেজিং ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে ব্যবহার হচ্ছে।

কোয়ান্টাম ডটের ভবিষ্যৎ ব্যবহার প্রসঙ্গে গবেষক ড. নকীব বলেন, 'ন্যানোটেকনোলজির জন্য যে ন্যানো-ম্যাটেরিয়াল, তার শক্তি দিয়েই সারা দুনিয়া এখন যেখানে কাঁপছে, আমরা আশা করি আরও ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম ডটের যেসব বৈশিষ্ট্য আছে তার মাধ্যমে ন্যানোটেকনোলজির কার্যকারিতা আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে। বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সবক্ষেত্রেই ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার আরও অনেক বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে।'

বুয়েটের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ন্যানো সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ড. আল-নকীব চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, 'আমরা এমনিতেই উচ্ছ্বসিত ন্যানোপার্টিকেল নিয়ে। কারণ কোনো বস্তু বা পদার্থকে ছোট করতে করতে ক্ষুদ্রতম অবস্থায় নিয়ে যেতে পারলে সেগুলোকে আমরা ন্যানোটেকনোলজিতে ব্যবহার করতে পারি। ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে পরিবেশ, এনার্জি, মেডিকেল সায়েন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সের অনেক নতুন নতুন দিক উন্মোচন করা সম্ভব হচ্ছে।'

ন্যানো-পার্টিকেল বা বস্তুর অতি ক্ষুদ্রকণার কোয়ান্টাম আচরণের বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা থাকলেও, নোবেলবিজয়ী তিন বিজ্ঞানী ক্ষুদ্রকণার নতুন আচরণ কাজে লাগাতে সক্ষম হন।

১৯৮০'র দশকে সোভিয়েত বিজ্ঞানী আলেক্সি আকিমভ প্রথম রঙিন কাঁচে কোয়ান্টামের প্রভাব দেখাতে সফল হন। কয়েক বছর পর মার্কিন গবেষক লুই ব্রুস প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে প্রমাণ করেন যে তরলে অবাধে ভাসমান কণার ওপর আকার-নির্ভর কোয়ান্টাম প্রভাব ফেলতে পারে। আর ফরাসি বিজ্ঞানী মুঙ্গি বাওয়েন্ডি ১৯৯৩ সালে কোয়ান্টাম ডট উৎপাদন করতে সক্ষম হন, যা অতিসূক্ষ্ম কণার দৈনন্দিন ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল।

বুয়েটের ল্যাবরেটরিতে ইতোমধ্যে কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করে বিভিন্ন গবেষণা চালানো হচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক নকীব চৌধুরী বলেন, 'আমাদের ল্যাবরেটরিতে ইতোমধ্যে কোয়ান্টাম ডট সিনথেসিস করে বিভিন্ন ডিভাইসে বা হাইড্রোজেন থেকে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার করছি। আমার শিক্ষার্থীরা এটি নিয়ে কাজ করছে। আমরা সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে সিনথেটিক পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম ডট বা ন্যানোক্রিস্টাল তৈরি করে সোলার সেল বা সৌরকোষে ব্যবহার করে কার্যকারিতা বাড়াতে গবেষণা চালাচ্ছি।' 

'এছাড়া, পানিকে ভেঙে হাইড্রোজেন এনার্জি তৈরি করা যায় কি না, এটারও গবেষণা আমরা করছি কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করে। এছাড়া কলকারখানার বর্জ্য থেকে পরিবেশের জন্য হুমকি এমন ম্যাটেরিয়াল বের করার জন্যও আমরা কোয়ান্টাম ডট ব্যবহার করছি,' যোগ করেন তিনি।

ন্যানোপ্রযুক্তির বিকাশে বাংলাদেশে একটি ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, '২০১২ সালে আমরা যখন দেশে ন্যানোটেকনোলজি সোসাইটি গঠন করি, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বলেছিলেন দেশে একটি ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিতে। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এ বিষয়ে একটা প্রকল্প নিয়েছে। তবে আমরা চাই একটা ন্যাশনাল সেন্টার, যেখানে সারা দেশের মানুষ কাজ করতে পারবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Govt bans AL until completion of ICT trial

Law Adviser Prof Asif Nazrul said this at a press briefing after a special meeting of the advisory council tonight

16m ago