নীল ঢেউয়ের স্রোতে বাংলাদেশের আরেক লড়াইবিহীন হার
পুরো গ্যালারি ছিল ভারতের নীল জার্সিতে ভরপুর। ম্যাচ জুড়েই তাই বারবার উঠল নীল ঢেউ। ভারতীয় বোলারদের ঝাঁজের পর ব্যাটারদের চার-ছক্কার তালে বাজল বাদ্য। ভক্তরা তাতে নিজেদের মিশিয়ে নিয়ে মাতলেন উৎসবে। এই তুমুল উৎসবের ভিড়ে বাংলাদেশ দল যেন ছিল অসহায়! হাতেগোনা কয়েকটি লাল-সবুজ জার্সি থাকল বিষাদে ভরা। সাড়ে তিনশ রানের উইকেটে দুর্দান্ত শুরুর পর মামুলি পুঁজি নিয়ে কোনো রকম লড়াইও যে করতে পারল না বাংলাদেশ!
পুনের মহারাষ্ট্র ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার কোনো কিছুই পক্ষে যায়নি লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের। ২৫৬ রানের পুঁজি নিয়ে প্রায় ৯ ওভার বাকি থাকতে ৭ উইকেটে হারই বলছে ম্যাচে কী হয়েছে। তবে খেলা দেখে থাকলে আরও প্রবলভাবে বোঝার কথা একপেশে ছবি। এতই একপেশে ম্যাচ যে ফল বাদ দিয়ে শেষদিকে বিরাট কোহলির সেঞ্চুরি হবে কিনা তা নিয়েই ছিল জল্পনা-কল্পনা। কোহলি তা করেছেনও দারুণভাবে।
২৫৭ রানের লক্ষ্যটা পুনের মাঠে কতটা সহজ তা বলতে পারে একটি পরিসংখ্যান। এই ম্যাচের আগে কমপক্ষে পাঁচ ওয়ানডে হয়েছে এমন ভেন্যুর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান রেট এই মাঠের। সেখানে ভারতের ব্যাটারদের বিপক্ষে বাধা হতে পারেননি শরিফুল ইসলাম-মোস্তাফিজুর রহমানরা।
টসের সময়ই বাংলাদেশের জন্য আসে নেতিবাচক খবর। চোটের কারণে নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসান নামতে পারেননি, যদিও ম্যাচের আগে তাকে ওয়ার্মআপ করতে দেখা যায়। তার বদলে নেতৃত্ব দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। সাকিব ম্যাচে না থাকলেও বাউন্ডারি লাইনে পায়চারি করে দেখেছেন দলের নাজুক অবস্থা।
সহজ লক্ষ্যে নেমে ভারতের দুই ওপেনার রোহিত শর্মা আর শুবমান গিল তোলেন ঝড়। বাংলাদেশের পেসারদের পিটিয়ে এলোমেলো করে দেন তারা।
একের পর এক বাউন্ডারিতে, ওভার বাউন্ডারিতে গ্যালারি উত্তাল করে তুলছিলেন তারা। খুব একটা ভালো বল না করলেও এই জুটি ভেঙে দেন হাসান মাহমুদ। তার বলে তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন ৪০ বলে ৪৮ করা রোহিত। ক্রিজে এসেই হাসানের 'উপহার' দেওয়া দুই ফ্রি হিটে চার-ছয় মেরে থিতু হয়ে যান বিরাট। ফিফটি করে ম্যাচ দ্রুত শেষ করে দেওয়ার তালে ছিলেন গিল।
মেহেদী হাসান মিরাজের বলে ছক্কার নেশায় গিল ক্যাচ দেন বাউন্ডারি লাইনে। মিরাজের বলে একই কাজ করতে গিয়ে পরে কাটা পড়েন শ্রেয়াস আইয়ারও। তবে কোহলিকে আর কাটা যায়নি। সুপারস্টার ব্যাটার ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি করেই শেষ করে দেন ম্যাচ।
দলের যখন ৮৮ রান, তখন ক্রিজে এসেছিলেন কোহলি। মাঠ ছাড়েন ৯৭ বলে ৬ চার ও ৪ ছক্কায় ১০৩ রান করে অপরাজিত থেকে। শেষদিকে ভারতের জয় ছিল এতই নিশ্চিত যে কোহলির সেঞ্চুরি নিয়েই ছিল যত রোমাঞ্চ। সেঞ্চুরি করতে কিছু সিঙ্গেল নেননি ইচ্ছা করে। টানা ১৯ বল স্ট্রাইকে থেকে নাসুম আহমেদকে ছক্কায় উড়িয়ে দুহাত উঁচিয়ে শেষ করে দেন ম্যাচ।
বোলিং-ফিল্ডিংয়ের হতাশার ছবি নিয়ে অনেক কিছুই বলা যায়। তবে মূল সর্বনাশ তো হয়েছে ব্যাটিংয়ে! অথচ টস জিতে ব্যাট করতে নেমে এসেছিল স্বপ্নের মতন শুরু। এতদিন যে ওপেনিং জুটিতে মিলছিল না সুখকর কিছু, এবার তারা ভরিয়ে দিতে থাকলেন দুহাত ভরে। কিন্তু তাদের দারুণ শুরু জলাঞ্জলি হলো মাঝের ওভারে।
লিটন দাস আর তানজিদ হাসান ৯৩ রানের জুটিতে রীতিমতো গড়েন রেকর্ড। বিশ্বকাপ মঞ্চে ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান করে ফেলেন তারা। বিশ্বকাপে আগের ২৪ বছরে বাংলাদেশের ওপেনিং জুটির সর্বোচ্চ ছিল সেই ১৯৯৯ সালে। শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ আর মেহরাব হোসেন অপি মিলে করেছিলেন ৬৯ রান।
লিটন-তানজিদ সেই রান ছাড়িয়ে ঝলক দেখাচ্ছিলেন, দলের প্রত্যাশাও বাড়ছিল। প্রবল চাপে থাকা দুজনেই স্কিল আর মনোবল দেখিয়ে ভারতীয়দের অস্বস্তি ফেলে দিয়েছিলেন, আর উজ্জ্বল হচ্ছিল বাংলাদেশের ক্যাম্পের মনোবল।
১৫তম ওভারে ৫১ করা তানজিদের আউটে গড়বড় হওয়ার শুরু। তিনে নেমে শান্ত এদিনও ফিরে যান দ্রুত। চারে নামিয়ে মিরাজকে দিয়ে কিছু করানো যায়নি। উল্টো এই দুজনের আউটে লিটন গুটিয়ে যান। রান রেটের চাপ হালকা করতে রবীন্দ্র জাদেজাকে বেরিয়ে মারতে গিয়ে ধরা দেন লং অফে। থামে তার ৬৬ রানের ইনিংস।
অথচ এই জাদেজাকে আগের ওভারেই দারুণ তিনটি চার মেরে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন লিটন। তার বিদায়ের পর অস্বাভাবিক মন্থর এক ইনিংস খেলে বিদায় নেন তাওহিদ হৃদয়। এবারের বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং অর্ডারও ওলট-পালট হয়েছে একাধিকবার। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়া তরুণ মানিয়ে নিতে যে পারছেন না সেটা স্পষ্ট। দুই অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ অবশ্য ছিলেন মন্দের ভালো।
ক্রিজে নেমে শুরু থেকে চনমনে মুশফিক স্লগ ওভারে ঝড় তোলার আগেই থামেন জাসপ্রিত বুমরাহর বলে। মাহমুদউল্লাহ শেষ ওভারে বোল্ড হওয়ার আগে করেন ৩৬ বলে ৪৬ রান। উইকেট বিচারে হয়তো স্লগ ওভারে আরও আগ্রাসী ব্যাটিং প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু বাকিদের ব্যর্থতায় তাকে বরং বাহবা দিতে হয়।
বাংলাদেশ ২৫৬ রান করার পরই ম্যাচে কী হতে যাচ্ছে তা যেন নির্ধারিত হয়ে যায়! অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন সবাই! ভারতের দর্শকরা ছিলেন উৎসবের অপেক্ষায়। উৎসবপ্রিয় ভারতীয়দের আনন্দে ভাসিয়ে রোহিতের দল বাংলাদেশকে গুঁড়িয়ে দিয়েই ছুটতে থাকল সেমিফাইনালের দিকে। টানা চার ম্যাচের জয়রথে তারা। আর চার ম্যাচের তিনটাতেই বড় ব্যবধানে হেরে বাংলাদেশ ঠিক উল্টোদিকে। এই তিন হারই আবার টানা তিন ম্যাচে।
Comments