কণ্ঠরোধ হচ্ছে ফিলিস্তিনি লেখকদেরও

শিবলির দোষটা কোথায়? শিবলির দোষ হয়তো একজন ফিলিস্তিনি লেখক হওয়া, একটি ফিলিস্তিনি গল্প বলা।

গত ১৩ অক্টোবর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ঘোষণা করা হয়, ফিলিস্তিনি লেখিক আদানিয়া শিবলি ও তার বই 'মাইনর ডিটেইল'র জন্য কোনো পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে না। শিবলি ও তার অনুবাদকের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত আলোচনা অনুষ্ঠানটিও বাতিল করা হয়।

এ বিষয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পরিচালক জুয়ের্গেন বুস বলেছেন, 'ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার সব মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই বইমেলা সবসময় মানবতার সঙ্গে ছিল, এর ফোকাস শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আলোচনার দিকে।'

কিন্তু জুয়ের্গেন বুস ব্যাখ্যা করেননি, হামাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন একজন ফিলিস্তিনি লেখককে কেন চুপ করিয়ে দিতে হবে, কেন ফিলিস্তিনিরা বইমেলার শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আলোচনার অংশ হতে পারবেন না। একজন ফিলিস্তিনির কাজের স্বীকৃতি দেওয়া ও জনসমক্ষে তার মতামত তুলে ধরার বিষয়ে বাধা দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্পষ্ট রেখেছেন।

যখন তারা শিবলির বইয়ের জন্য প্রথম পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল, তখন লিটপ্রম তার উপন্যাসটিকে অক্ষরে অক্ষরে রচিত একটি শিল্পকর্ম হিসেবে বর্ণনা করেছিল, যেখানে সীমানার শক্তি ও সহিংস সংঘাতগুলো মানুষের জীবনে কী ঘটায় তা বলা হয়েছে।

লিটপ্রমের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তাদের লক্ষ্য 'গ্লোবাল সাউথের সাহিত্যকে তুলে ধরা ও আমরা যে বিশ্বে বাস করি সেখানে ভিন্ন, কিন্তু সমানভাবে প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে তা জানতে' পাঠককে সহায়তা করা।

কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। কারণ পাশ্চাত্যে দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘৃণা ও সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। সম্প্রতি হামাসের হামলার জন্য সম্মিলিতভাবে পুরো ফিলিস্তিনিদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, গাজায় সংঘটিত মানবিক বিপর্যয় নিয়ে পশ্চিমারা একপ্রকার নিশ্চুপ। ফিলিস্তিনিদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

শিবলির উপন্যাসটি (২০২০ সালে এলিজাবেথ জ্যাকুয়েট ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন) দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথমটি হলো ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজে প্রকাশিত। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের অল্প সময় পর ১৯৪৯ সালের গ্রীষ্মে ইসরায়েলের দক্ষিণে মিশরের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি লাইনে টহলরত একদল ইসরায়েলি সেনা ইউনিট একটি বেদুইন মেয়েকে আটক করে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে তারা তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে।

বইটির দ্বিতীয়ার্ধে, ২০০৪ সালে রামাল্লায় বসবাসকারী একজন ফিলিস্তিনি নারী সেই ঘটনা পড়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি ঘটনাস্থল দেখতে চেকপয়েন্টগুলো পার হয়ে ইসরায়েলের দক্ষিণে ভ্রমণ করেন। শিবলির গল্পটি পড়লে স্তব্ধ হয়ে যেতে হবে, ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসবে।

সাহিত্যপণ্ডিত ও সমালোচক রবিন ক্রেসওয়েল এটিকে 'ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির ট্রমা' বলে অভিহিত করেছেন।

শিবলির বইটি মুষ্টিমেয় জার্মান সমালোচকদের কাছে ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছে। তবে, সেই মুষ্টিমেয় মানুষ এই অভিযোগের সমর্থনে কোনো প্রমাণ দেখাননি। শিবলি বইয়ে যে অপরাধের কথা বর্ণনা করেছেন তা মিথ্যা বলার মতোও কোনো যুক্তি নেই। এমনকি বইতে তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

তাহলে শিবলির দোষটা কোথায়? শিবলির দোষ হয়তো একজন ফিলিস্তিনি লেখক হওয়া, একটি ফিলিস্তিনি গল্প বলা।

ঘটনা শুধু শিবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মিশরীয় অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাবেক রাজনৈতিক বন্দী প্যাট্রিক জাকি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে 'সিরিয়াল কিলার' আখ্যায়িত করায় তার নতুন স্মৃতিকথার বইয়ের প্রদর্শনী আটকে দেওয়া হয়েছে। অথচ ইসরায়েলিরা সাম্প্রতিকে সময়ে তাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আরও খারাপ কথা বলেছে।

এছাড়াও, ব্রিটিশ পুলিশ 'নিরাপত্তা উদ্বেগ' দেখানোয় 'এ ডে ইন দ্য লাইফ অব আবেদ সালামা' বইয়ের প্রদর্শনীর একটি অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। জেরুজালেমে বসবাসরত ইহুদি আমেরিকান সাংবাদিক নাথান থ্রাল এই ননফিকশন বইটি লিখেছেন। তিনি তার ফিলিস্তিনি বন্ধুর চোখে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অধীনে জীবনের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। তার ওই বন্ধু এক বাস দুর্ঘটনায় ছেলেকে হারিয়েছিলেন।

এই তালিকা আরও বেড়েছে। গত ১২ অক্টোবর জেনিন শরণার্থী ক্যাম্পভিত্তিক ফিলিস্তিনি গ্রুপ ফ্রিডম থিয়েটারের একটি নাটক বাতিল করেন ফরাসি শহর চোইসি-লে-রোইয়ের মেয়র। যুক্তরাষ্ট্রে, এমনকি বর্তমান সংঘাতের আগেও ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো যাচাই করা হচ্ছিল।

গাজার মানুষ যখন ক্ষুধার্ত ও বোমাবর্ষণের শিকার হচ্ছে, তখন নিরীহ মানুষের সুরক্ষায় ফিলিস্তিনি ও অন্যদের কথা ও লেখাসহ যে কোনো সৃজনশীল কাজকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা বিস্ময়কর। ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে ফ্রান্স। বার্লিনের স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের কাফিয়া না পরার নির্দেশ দিয়েছে। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলন অবৈধ হতে পারে।

ফিলিস্তিনিদের ক্রমাগত সহিংসতার নিন্দা জানাতে বলা হয়। কিন্তু তারা যা কিছু করেছে সবই সহিংসতা হিসেবে সাজানো হয়েছে। যেমন- ২০১৮ সালে গাজা সীমান্তে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করা থেকে শুরু করে বয়কটের প্রচারণা চালানো, নাটক বা উপন্যাস লেখা।

হামাসের হামলাকে পুঁজি করে সব ফিলিস্তিনি কণ্ঠস্বর অকার্যকর করার এই নিন্দনীয় কাজ সহানুভূতি, চিন্তা, বিতর্ক ও সত্যকে সংকুচিত করার একটি অংশ। এটা মেনে নেওয়া মানে আমাদের সম্মিলিত বাক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া।

সূত্র: কনভারসেশন, ওয়াশিংটন পোস্ট, আনাদোলু পোস্ট

Comments

The Daily Star  | English

Desire for mobile data trumps all else

As one strolls along Green Road or ventures into the depths of Karwan Bazar, he or she may come across a raucous circle formed by labourers, rickshaw-pullers, and street vendors.

14h ago