শ্রদ্ধা

হুমায়ূন আহমেদের শত্রু-মিত্র

নীরবতার একটা রাজনীতি দীর্ঘকাল হুমায়ূনকে ঘিরে চালু ছিলো। তিনি যেন বাংলা সাহিত্য সমালোচকদের ভাশুর, ভাশুরের নাম মুখে আনতে নেই!

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন আজ। তাঁকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে হচ্ছে হবে। সেই প্রসঙ্গে আমার কিছু বিবেচনা হাজির করতে চাই। আমার দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ বলে, বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তিনটি দল আছে। একদল তাকে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে গণ্য করেন এবং তার যেকোন লেখা নিয়ে উন্মাদনায় ভোগেন। এনারা হুমায়ূন আহমেদ চর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শত্রু। কোন ধর্ম, রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, মতবাদ কিংবা এবং ব্যক্তিকে নিয়ে উন্মাদনা, এক তরফা ভক্ত হয়ে থাকা আদতে শত্রুতাই।

জগতে এমন কোন কিছু নেই, সে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম--- সকলের কাছেই এক রকমের গ্রহণযোগ্য হবে। এক বই পড়া পাঠক থেকে যেমন সাবধান থাকতে হবে তেমনি এক লেখকে মুগ্ধ পাঠক থেকেও সাবধান থাকতে হবে। যে লোক কেবল কাফকা কিংবা জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথ কিংবা হুমায়ূনের মতো একজন লেখক এবং তার লেখা ঘিরেই ঘুরপাক খান সে লোক সাহিত্য জগতে এক বিভ্রান্ত ষাঁড়। লাল কাপড়ের দুলুনিতে তিনি মাজারের লালসালু দেখেই গলে পড়েন।

দ্বিতীয় দলটি-  হুমায়ূন আহমেদকে কোন লেখকই মনে করেন না। একবাক্যে তারা হুমায়ূন আহমেদকে বাতিল করে দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না উভয়েই সাহিত্যের শত্রু। একজন লেখকের সকল বাক্যই যেমন বেদবাক্য নয়, একজন লেখককে নিয়ে যেমন মাথায় তুলে নাচবার নয়, তেমনি একজন লেখকের সকল বাক্যই ফালতু নয় এবং একজন লেখককে মাথায় তুলে আছাড় দেয়াও সঙ্গত নয়। অতি পীরিতি এবং অতি ঘৃণা দুটোই সন্দেহজনক। কাজেই যারা হুমায়ূন জ্বরে ভোগেন, তাদের ইলোকট্রলাইয়েড ইমব্যালেন্স ঠিক হওয়া জরুরি। 

এইবার তৃতীয় দলের কথায়। এরা ধর্মেও নাই, জিরাফেও নাই। অধিকাংশ বাঙালি সুইট প্রজাতির। কথিত নিরপেক্ষ, নির্বিকার দল--- তারা রাজনীতি, বাজারনীতি, দুর্নীতি, ধর্ম ইত্যাকার বিষয়ে যেমন মাথা ঘামায় না, তেমনি কে হুমায়ূন, কেন হুমায়ূন এসব নিয়েও ভাবে না। এদের মধ্যে আবার একদল এককাঠি সরেস, তারা হুমায়ূনকেই চেনেন না, কদাচ চিনলেও পাত্তা দেন না। সে বিষয়ে আমাদের আলাপও নেই।

আমাদের আলোচ্য বিষয় হুমায়ূনের পক্ষের, আর বিপক্ষের দল। বলার অপেক্ষা রাখে না, হুমায়ূন অন্ধ এবং হুমায়ূন বিদ্বেষী দুটো দলই চরমপন্থী। জগতের সকল চরমপন্থীকে শুধু বিনীত ভাবে বলতে চাই, ঢালাওভাবে কোন কিছু বিচার করা হয় শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এক চোখা দৈত্য লোক গল্পে মানায়, আধুনিক সাহিত্য তেমন করে পড়লে ব্যাপারটা বেমানান। পক্ষেই বা বিপক্ষেই হোক এক চেটিয়া মতামত দিলে পরিবেশ নষ্ট হয়। এই পরিবেশ বিনষ্টকারীরা শুধু হুমায়ূন নয়, সাহিত্যেরই শত্রু। অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো কেউ লেজ হাতায়, কেউ শুঁড় হাতায়। 

সমকালের বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার সাহিত্য ও শিল্প সম্পর্কে নেহাত প্রশংসা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলেই আমাদের দায় শেষ হয় না। সময়ের আলোচিত এই ব্যক্তিত্বের সৃষ্টিকর্মের বিশ্লেষণ ও আলোচনা অবশ্যই সময়ের দাবী। কিন্তু সেই দাবী কি আমরা পালন করেছি? না, করিনি। আমার জানা মতে, হুমায়ূন জীবিতকালে তার বহু গুণমুগ্ধ সঙ্গী ছিলো, যাদের মধ্যে অনেকেই লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী, সমালোচক, সম্পাদক, অধ্যাপক ছিলেন। 

ইনারা সবাই যদি হুমায়ূন সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা বলতেন, হুমায়ূনের একটি করে বই নিয়েও আলোচনা করতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্য আলোচনাতেও একটা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতো। দুয়েকটা ব্যতিক্রম তো আছেই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাজারে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যে ধরণের বই বা লেখা পাওয়া যায় তা ব্যক্তি হুমায়ূন বন্দনা। তিনি কবে কার সঙ্গে হেঁটেছেন, খেয়েছিলেন, কবে তিনি বেড়াতে গিয়ে কাকে কি বলেছিলেন সেইসব আলাপই বেশি। এ সব আলাপ অহেতুক নয়, এর চেয়ে জরুরি ছিলো হুমায়ূন সাহিত্য নিয়ে যথাযথ বিশ্লেষণ। তা একেবারে অপ্রতুল। 

সচেতনভাবে যারা হুমায়ূন সাহিত্যের গঠনমূলক আলোচনা করেননি, এক 'নন্দিত নরকে' আর 'শঙ্খনীল কারাগার' পড়েই যারা দায় সেরে ফেলেছেন তারাও হুমায়ূনের শত্রু। এ দেশের অনেক কথিত বড় লেখক, সমালোচকই হুমায়ূন সাহিত্য নিয়ে নির্দিষ্ট করে আলাপ করেননি। করা উচিত ছিলো। একজন আহমাদ মোস্তফা কামাল কিংবা মোহাম্মদ আজমের মতো নিবিড়, নিরপেক্ষ সাহিত্যালোচনা স্বাস্থ্যকর। আমরা অন্তত এই নজিরটা তৈরি করতে পারতাম যে, লেখক, কবি চলে গেলে তার ব্যক্তি জীবন শুধু নয়, তার কর্ম নিয়েও সমালোচনা হতে পারে, হওয়া উচিত। 

স্মৃতিচারণ যদি তা নির্মোহ হয়, তবে তা ভালো, মুগ্ধতার আবেশ কাটিয়ে লেখকের জীবনের সঙ্গে তার লেখাকে মিলিয়ে দেখতে পারা আরও ভালো। কিন্তু আফসোস, তেমন সুজন সাহিত্যিক হুমায়ূন নিয়ে লেখেননি কিংবা লেখতে চাননি। নীরবতার একটা রাজনীতি দীর্ঘকাল হুমায়ূনকে ঘিরে চালু ছিলো। তিনি যেন বাংলা সাহিত্য সমালোচকদের ভাশুর, ভাশুরের নাম মুখে আনতে নেই!  

আমাদের যেমন সাহিত্য মুরিদ দরকার নেই তেমনি সাহিত্য মাতব্বরও দরকার নেই। বিংশ শতাব্দী পার হয়ে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে সাহিত্যকে সকল রকমের প্রভাব বলয়ের বাইরে চিন্তা করতে হবে। একজন লেখক কতো লিখেছেন, কতো কামিয়েছেন, কতো জনপ্রিয়, কতো অহংকারী এইসব আলোচনা বাদ দিয়ে লেখকের ঘোষিত মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পর তার লেখা থেকে তাকে আবিষ্কার করতে হবে। সেই আবিষ্কার, অনুসন্ধানের দায় কেউ না নিলেও  ইতিহাসের কিছু যায় আসে না। কারণ হুমায়ূনের পরম মিত্র তার পাঠক, বিশেষত তারুণ্য। তারাই বরং আজ কথা বলুক হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো নিয়ে।

প্রযুক্তি আমাকে আপনাকে লেখা প্রকাশের পথ সহজ করে দিয়েছে। নানা রকমের ব্লগ, সোশ্যাল মিডিয়া, ই-পত্রিকা আপনাকে লেখার সুযোগ করে দিয়েছে। অতএব আসুন হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে আমরা হুমায়ূন চর্চার নতুন দিনের সূচনা করি, প্রত্যেকে আমরা হুমায়ূন আহমেদের একটা করে বই নিয়েও যদি কথা বলি, জোকের মুখে নুন পড়বেই। আলো আসবে ঘরে বাহিরে।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda returns home after 6 days in hospital

Thousands of party activists, along with senior BNP leaders, are escorting Khaleda's convoy back to her Gulshan residence

32m ago