নীরবে সহে যে কবি কীর্তিমান 

ইংরেজ কবি শেলি বেঁচেছিলেন ৩০ বছর। বাঙালি কবি আবুল হাসান বেঁচেছিলেন তার চেয়েও এক বছর কম। প্রসঙ্গে শামসুর রাহমান বলেছেন, এ কবির মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষীণায়ু জন কিটস ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা। শামসুর রাহমান এখানে শেলির নামটি নেননি। কিন্তু শেলি ও হাসানের জীবন ও প্রতিভায় আমরা সাদৃশ্য ও মহত্তম এক বৈসাদৃশ্য খুঁজে পাই।

কাকতালীয় না মহাজাগতিক ইশারা, সে বিষয়ে আমরা সংশয়িত হই। যখন দেখি, শেলি ও হাসান জন্মেছেন (৪ আগস্ট) একই তারিখে। শেলি জন্মেছিলেন ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে। হাসান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। দেড় শতকের দূরত্ব রয়েছে তাদের আবির্ভাবে, আগমনে। কবি-অকবি উভয়ের কাছে দুজনই আদৃত ও সমীহ এক নাম। তাদের কবিতা আজও পঠিত, আলোচিত ও মানুষের কাছে আশ্রয়যোগ্য।

কালের বাস্তবতায় শেলির কবিতা যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও খারিজ হওয়ার মুখোমুখি হয়েছে, হাসানের কবিতা সেভাবে নয়। এখানেই শেলির সঙ্গে আমরা হাসানের মহত্তম এক বৈসাদৃশ্য ও স্বাতন্ত্র্য অবলোকন করি। এ আবিষ্কার আমাদের বিস্মিত যেমন করে তেমনি অভাবিত আনন্দও দেয়। এখানে আমরা ছোট-বড় কিংবা এগিয়ে-পিছিয়ে থাকার সীমাবদ্ধতায় জারিত হইনি। আমরা কতিপয় প্রসঙ্গের আলোকে বুঝে নিচ্ছি আমাদের অভীপ্সা ও অভিমুখ। যেখানে আমাদের উদ্দিষ্ট শেলি ও হাসানকে কালের আরশিতে চকিতে দেখে নেওয়া ও মহত্তম বৈসাদৃশ্যের তালাশ করা।

শেলি সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রেম অটুট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার সাহিত্যের উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, 'আমি আজকে শেলিকে আমাদের এ সভায়, আমাদের এ বাঙালির সভায়, আদর করে ডাকছি; আমি এ জন্যই বলছি, তোমার বাণী আমাদের বাণী। তোমার কাব্যে পৃথিবীর সব মানুষের কথা, বিশেষভাবে আমাদের এই কালের, আমাদের এই দেশের। প্রবল বিদ্রোহ নিয়ে তিনি যেসব প্রচণ্ড শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দ্বারা পীড়িত হয়েছেন, তাড়িত হয়েছেন, সেই শক্তি আমাদের পুরো দেশকে ব্যাপ্ত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার দুর্গ বাইরে নয়, মনে। এই যে প্রচণ্ড শক্তি, এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, বিদ্রোহের ধ্বজা তুলতে হবে! কবির কাছ থেকে তার সম্মতি আসবে। 

এ জন্য বলছি, আজকের দিনে তোমাকে আমরা অভিবাদন করি, তোমাকে আমরা আহ্বান করি আমাদের মনের মধ্যে, আমাদের আপনাদের মধ্যে, তুমি তোমার সিংহাসন গ্রহণ করো।'

বিশ্বের সব বড় বড় কবির যে শেলির প্রতি এ মুগ্ধতা ছিল, তা নয়। বিশেষ করে এলিয়ট শেলিকে যেভাবে সরাসরি আক্রমণ ও বাজে বলেছেন, তা আমাদের মাঝে কৌতূহল উদ্রেক করে। এলিয়ট ১৯৩৩ সালে হার্ভার্ডে একটি বক্তৃতা দেন। বিষয় ছিল শেলি ও কিটস। সেখানে তিনি কবিতা নিয়ে তার ভাবনা ও অনুভূতির কথা বলেছেন। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিনি যে সিদ্ধান্তে দাঁড়ি টেনেছেন, তা শেলির কবিতা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত ও চলমান কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

এলিয়ট বলেছেন, শেলির কবিতা তার ভালো লাগে না। অথচ সে সময় শেলি বিশ্বকবিতায় দোর্দণ্ড-প্রতাপে উচ্চারিত ও উচ্চকিত নাম। এলিয়টের মতে, শেলির কবিতা তার ভালো লাগে না। কারণ-

ক. অন্ত্যমিলের ঝুনঝুনি আওয়াজ।

খ. কবিতার মতামতগুলো খেলো (bad jingling)। [আবু সয়ীদ আইয়ুব bad jingling-এর অনুবাদ করেছেন `বাজে' বলে।]

এলিয়ট বলছেন, তার মনে হয়েছে, শেলির কবিতায় সবমসয়ই পরিণত বুদ্ধির অভাব দৃশ্যমান হয়েছে। তার আইডিয়া আমার কাছে কিশোর বয়সের আইডিয়া বলে মনে হয়। এলিয়ট শেলির আইডিয়াকে অরুচিকর বলেও মন্তব্য করেছেন। [('find his ideas repellent'), The Use of Poetrz and the Use of Criticism, p.90]

এখন আমরা দেখব, হাসানের কবিতায় এলিয়টের উচ্চারিত অভিযোগগুলো প্রযোজ্য কি না। এলিয়ট যেভাবে শেলির কবিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তার নির্যাস যদি আমরা নির্বাচন করি, তাহলে এক শব্দে বাজে অভিধা প্রযোজ্য। এখন এই বাজে কি হাসানেরও শিরস্ত্রাণ হতে পারে? হাসানের কবিতার আলোকেই এর মীমাংসা করা প্রয়োজন।

হাসান কী বলছেন তার কবিতায়, আমরা কয়েকটি কবিতার নির্বাচিত পঙক্তি চয়ন করে দেখে নিই।

উদাহরণ এক : সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,/ মায়াবী করুণ/এটা কি সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?/এটা কি পাথর, নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?/পৃথিবীর তিন ভাগ জলের সমান কারও কান্না ভেজা চোখ? এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ণ রূপান্তর,/একটি নামের মধ্যে নিজেরই বিস্তার ধরে রাখা,/তুই যার অনিচ্ছুক দাস! তবে কি সে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল কোনো দিন/ ভালোবেসেছিল সে যুবতীর বাম হাতে পাঁচটি আঙুল?/ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল? (আবুল হাসান )।

উদাহরণ দুই : আমি জানি না দুঃখের কী মাতৃভাষা/ভালোবাসার কী মাতৃভাষা/বেদনার কী মাতৃভাষা/যুদ্ধের কী মাতৃভাষা।/আমি জানি না নদীর কী মাতৃভাষা/নগ্নতার কী মাতৃভাষা/একটা নিবিড় বৃক্ষ কোন ভাষায় কথা বলে জানি না। শুধু আমি জানি, আমি একটি মানুষ, আর পৃথিবীতে এখনো আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা। (মাতৃভাষা )

উদাহরণ তিন : শিল্প হলো স্বাতীর হাতের ওই কমলালেবু,/লজ্জায় আনত মুখ, রোদের ফড়িং/ শিল্প হলো স্বাতীর কানের রিং/চুল থেকে টেনে আনা সুগন্ধের সমস্ত বাতাস,/শিল্প হলো আঙিনায়, উঠোনে স্বাতীর জলে/জীবনের সিক্ত তাজা ঘাস! শিল্প তো স্বাতীর বুকে মানবিক হৃৎপিণ্ড, তাই আমি তার হৃৎপিণ্ডে বয়ে যাই চিরকাল রক্তে আমি/শান্তি আর শিল্পের মানুষ! (স্বাতীর সঙ্গে এক সকাল: আ. হা.)

উদাহরণ চার : ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভেতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও! (ঝিনুক নীরবে সহো)

উদাহরণ পাঁচ : অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!/ জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!/দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন। (পাখি হয়ে যায় প্রাণ)

উদাহরণ ছয় : মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম/পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না!/পৃথিবীতে তবু আমার মতো কেউ রাত জেগে/নুলো ভিখারির গান, দারিদ্র্যের এত অভিমান দেখল না! (জন্ম-মৃত্যু জীবনযাপন)

হাসানের এসব কবিতা পাঠে কি আমাদের মনে হয়, এলিয়ট শেলির কবিতা সম্পর্কে যা যা বলেছেন, তা রয়েছে? না নেই। হাসানের কবিতায় অন্ত্যমিলে প্রাবল্য নেই। শেলির কবিতায় যে 'ব্যাড জিংলিং' দেখেছেন এলিয়ট, তা এখানে নেই। এমনকি হাসানের প্রথম দিককার কবিতাও এ অভিযোগমুক্ত। শামুসর রাহমান লিখেছেন, তিনি (আবুল হাসান) ক্রমেই পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এ পরিণতির স্বাক্ষর বহন করছে আবুল হাসানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'পৃথক পালঙ্ক'। এই 'পৃথক পালঙ্ক' তার কবিতার স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক। তিনি চিরদিন পৃথক পালঙ্কে সমাসীন থাকবেন। বাংলাদেশের কবিগোষ্ঠী যাদের কবিতা আমৃত্যু বারবার পড়বে, আবুল হাসান নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম। আমরা মনে করি, পৃথক পালঙ্কে হাসান স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিলেও কবিতা ভুবনে আগমন থেকেই তিনি রাজকুমারের স্বাক্ষর রেখেছেন। এ কারণে তার কবিতায় অন্ত্যমিলের কোনো আধিক্য নেই, তাই সেখান ঝুনঝুনির আওয়াজও ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তোলে না।

হাসানের কবিতার কোনো মতামতই খেলো (puerile) নয়। আবু সয়ীদের ভাষায় বাজে শব্দের প্রয়োগ কি হাসানের কবিতার মতামতে খেলা করে? উপরের উদাহরণগুলোয় কি তেমনটা দৃষ্ট হয়? হাসানের কবিতার আরও কয়েকটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে।

উদাহরণ এক : আমার জন্ম হয়নি। আমি কখনো আসিনি,/আমার মৃত্যুও হয়নি। মৃত শব্দ আমার অজ্ঞাত।/আমি প্রবাহিত বোধির ভেতর কোনো অতীত/এবং ভবিষ্যৎ নই। অতীত ও আগামী সব এক স্রোতে/মিশে গিয়ে আমার ভেতরে এক অনাবিল বর্তমান। (বিছা শিরোনামহীন কবিতা, ১০)

উদাহরণ দুই : আমার হাঁটুর ভেতর থেকে আমি জন্ম দেব/আমার নদী আমার গঙ্গা-কপোতাক্ষ বাঁধের শস্যক্ষেত (জন্ম )

উদাহরণ তিন : ওকে ঘরে ফিরে যেতে দাও। যে যাবার/সে চলে যাক, তাকে আর বসিয়ে রেখো না। (বনভূমিকে বলো)

উদাহরণ চার : সুন্দরীর মাংস মজ্জা খেলে/ সুন্দরীর হাত দিয়ে বানালে চিরুনি তুমি/সারা রাত শুয়ে শুয়ে চুল আঁচড়ালে! (ট্যুরিজম)

হাসানের কোনো মতামতই বাজে নয়। বাজে যে নয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো হাসানের সর্বত্রগামিতা। কবি-অকবি সবার কাছেই হাসানের কবিতা প্রিয়। হাসানের সবচেয়ে ব্যতিক্রমিতা হল, তিনি কবিতাকে অনেক বেশি পাঠযোগ্য করে তুলেছেন। শিল্পের নান্দনিকতা বজায় রেখে কবিতাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে হাসান অন্যতম। বাজে হলে তার কবিতার এ অভিগমন কখনই সম্ভব হতো না। হাসানের পক্ষে কেন ও কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল, তার ইঙ্গিত মেলে কবি-সমালোচক আবু হেনা মোস্তফা কামালের বয়ানে-ক্রিটিক ভাষ্যে। তিনি বলেছেন, চূড়ান্ত ব্যবচ্ছেদ করলে তার (আবুল হাসান) ভেতরে মায়া ও মমতা, মানুষের জন্য দুঃখবোধ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।

একজন সত্যিকারের কবিই তো যিশু খ্রিষ্টের মতো সব মানুষের হয়ে দুঃখ পান। সবচেয় বড় কথা হলো, হাসানের কবিতাকে বা তার আইডিয়াকে কোনোভাবেই কিশোর বয়সের আইডিয়া বলা যাবে না। এলিয়ট যেমন বলেছেন, শেলির কবিতা সম্পর্কে। শেলি ও হাসান স্বল্পায়ু কবি বটে, তাদের অনেক বিষয়ে সাদৃশ্যও অবিভাজ্য নয়। ব্যক্তিজীবনেও সমান্তরাল দুঃখ-কষ্ট-বেদনার ছায়া দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। প্রেমের ঘাত-প্রতিঘাতেও উভয়ই ক্রুশবিদ্ধ যিশু। আবার উত্তরণেও যেন নকলনামা, যা কবুল করতে হয় উভয়ের কাব্যস্বভাবকে প্রতিতুলনায় রেখে।

শেলি লিখেছেন, I think one is always in love with something or other; the error consists in seeking in a mortal image the likeness of what is perhaps, eternal. (মানুষ সর্বদাই কিছু না কিছু ভালোবাসিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহে; কিন্তু যাহা অনন্ত যাহা অবিনশ্বর, তাহাকে এই মর্ত্য-দেহের মধ্যে খোঁজা ভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছু নয়!)

হাসান লিখেছেন, আমি আর ফিরব না, আর আমি কোনো দিন/কারো প্রেমিক হব না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাই আজ/আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হব! (প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী)

শেলি ও হাসানের এসব সাদৃশ্য যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি গবেষণালব্ধ মহত্তম এক বৈসাদৃশ্য হলো তাদের সাহিত্যকীর্তির ফারাক। এলিয়টের আরশিতে সেই ফারাকটা ধরা পড়ে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Trump deploys military in LA to quell anti-immigration protests

About a dozen National Guard members were seen in video footage on Sunday morning lining up at a federal building in downtown Los Angeles, where detainees from immigration raids on Friday were taken, sparking protests that continued on Saturday.

31m ago