মানুষের ভাষা ‘পড়তে পারা’ হুদহুদের ‘আক্ষেপ’

কথিত আছে যে পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারা নবীমহামতি হজরত সোলায়মান (আ.)- এর সভাসদ ছিল এক হুদহুদ। রাজা সোলায়মানের সাহচর্যে থেকে মানুষের ভাষা আয়ত্ব করে নিয়েছিল রাজকীয় এই পাখি।
হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে রাজকীয় হুদহুদ। ছবি: মোছাব্বের হোসেন

কথিত আছে যে পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারা নবীমহামতি হজরত সোলায়মান (আ.)- এর সভাসদ ছিল এক হুদহুদ। রাজা সোলায়মানের সাহচর্যে থেকে মানুষের ভাষা আয়ত্ব করে নিয়েছিল রাজকীয় এই পাখি। কিন্তু এই গুণ কেবল এর আফসোসই বাড়িয়েছিল।

কিন্তু কেন?

বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের 'হুদহুদ পাখির কৈফিয়ত' শিরোনামের কবিতায় এর জবাব পাওয়া যাবে।

কবিতায় রাজা সোলায়মানকে উদ্দেশ্য করে হুদহুদকে বলতে শোনা যায়, '…আপনার সোহবতে থেকে আমি/দুনিয়ার সাদাকালো হলুদ সকল আদম জাতির ভাষা এখন বুঝতে পারি।/আহা মানুষের ভাষা যদি আমার জন্য দুর্বোধ্য হতো কতই না ভাল ছিল।'

এর পরের লাইনেই নিজের 'বাচালতার' জন্য রাজা সোলায়মানের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে হুদহুদ। বলে ওঠে, 'মানুষ যা কিছু বলে এর অর্ধেকই/মিথ্যে প্রতিশ্রুতি যা কক্ষনোও রক্ষিত হয় না।'

এই হুদহুদই তখনকার ইয়েমেন অঞ্চলের শেবা রাজ্যের সূর্য-উপাসক রানি বিলকিসের কাছে সোলায়মানের বার্তা নিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র কোরআনের সুরা নমলের ২৪টি আয়াতেও এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি খ্রিস্টান ও ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থেও হুদহুদের কথা এসেছে।

এছাড়া দ্বাদশ শতকে ইরানের সুফিকবি ফরিদউদ্দিন আত্তার 'মানতিকুত তায়ির' অর্থাৎ 'পাখি সম্মেলন' নামে যে মহাকাব্য লিখেছিলেন তার নায়কও ছিল হুদহুদ।

মাথায় বিশাল মুকুটটি ভাঁজ করে জেব্রা-ডোরা ডানা দুটি গুটিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে চলে মোহনচূড়া। ছবি: মোছাব্বের হোসেন

যে পাখিটি নিয়ে এত কথা, এই বাংলা অঞ্চলে তা 'মোহনচূড়া' নামেও পরিচিত। সম্ভবত পাখিটির মাথায় থাকা দৃষ্টিনন্দন বড় মুকুটটির জন্য এমন নামকরণ। শোনা যায় নামটি দিয়েছিলেন গল্পকার বনফুল। আবার কোথাও কোথাও একে ডাকা হয় 'হুপো' নামে। উপ..উপ..উপ আওয়াজ করে ডাকে।

পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক জানাচ্ছেন—ব্যতিক্রমী, অবিশ্বাস্য এমনকি নানা অলৌকিক কর্মকাণ্ড হুদহুদের ট্রেডমার্ক। বাংলাদেশের মাঠঘাট আর ঝোপঝাড়ে চোখ রাখলেই হুদহুদ পাখি দেখা যায়। কীটপতঙ্গের খোঁজে ময়লা ফেলার জায়গা আর ভাগাড়ে এর নিত্য আনাগোনা। তবে এটি কখনো কাক-শালিকের মতো শোরগোল করে সদলবলে আসে না। মাথায় বিশাল মুকুটটি ভাঁজ করে আর জেব্রা-ডোরা ডানা দুটি গুটিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে চলে। এখানে সাধারণত শীতকালেই দেখা মেলে এদের।

পাখিটি নিয়ে আরও যে তথ্য জানাচ্ছেন এই ভূপর্যটক তা হলো, এই অঞ্চল থেকে প্রতিবছর হিমালয় পার হয়ে এ পাখি চীন, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়া যায় এবং ওই পর্বতমালা পেরিয়েই ফিরে আসে। পরিযায়নের সময় পুরুষ ও স্ত্রী হুদহুদ আলাদা উড়ে চলে। অনেক সময় দুই সঙ্গী দুই মহাদেশেও চলে যায়। কিন্তু আলাদা হলেও অটুট থাকে তাদের পারিবারিক বন্ধন। জীবিত ফিরতে পারলে পরের বছর এরা আবার মিলিত হয় প্রজননস্থলে, ঘর বাঁধে।

হুদহুদের শরীর বাদামি এবং ডানা ও লেজে সাদা-কালো দাগ আছে। মাথায় সুন্দর একটি ঝুঁটি। সেই ঝুঁটির হলদে বাদামি পালকের শীর্ষ কালো রঙের। ইতিহাসের পাতায় জায়গা নেওয়া এই পাখি ২৫-৩২ সেন্টিমিটার (৯.৮-১২.৬ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাখা দুটি ছড়িয়ে দিলে তা ৪৪-৪৮ সেন্টিমিটার (১৭-১৯ ইঞ্চি) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ওজন ৪৬-৮৯ গ্রাম পর্যন্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Upupa epops আর ইংরেজি নাম Common Hoopoe/ Eurasian Hoopoe।

২০১৪ সালে ভারতের ওডিশা ও অন্ধ্র প্রদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছিল হুদহুদ। এমন নামকরণের সুপারিশ করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান।

এ সংক্রান্ত বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, পাখিটি শুধু ওমান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ এবং আফ্রিকার মিসর, চাদ, মাদাগাস্কার, এমনকি ইউরোপের কয়েকটি দেশ, এশিয়ার ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশেও অতিপরিচিত। দেশভেদে কেবল নামকরণেই কিছুটা পার্থক্য। আরবির মতো উর্দুতেও একে হুদহুদ নামে ডাকা হয়। মূলত ইউরেশিয়া এলাকার এই পাখিটি 'ওল্ড ওয়ার্ল্ড বার্ড' বলে পরিচিত।

হুদহুদ পাখি গাছের কোটরে বাসা করে। কেউ সেই বাসার কাছে গেলেই দুর্গন্ধময় তরল ছুড়ে মারে। বিকট গন্ধের তরল পদার্থ তৈরি করা ও ছুড়ে মারার জন্য স্ত্রী হুদহুদের পশ্চাদ্দেশে বিশেষ গ্রন্থি (গ্ল্যান্ড) থাকে।

এই পাখি নিয়ে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, ২০০৮ সালে গণভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাই করে হুদহুদকে জাতীয় পাখি নির্বাচন করেছে ইসরায়েল।

আর হুদহুদ সম্পর্কে মন খারাপ করা ঘটনাটি হচ্ছে, পাখিটির পর্যবেক্ষণ ও দূরের জিনিস দেখার ক্ষমতা অসাধারণ হলেও শিকারের জন্য কাছাকাছি পেতে রাখা ফাঁদ এটি দেখতে পায় না। তাই বেঘোরে মারা পড়ে মানুষের হাতে।

সম্প্রতি হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে হুদহুদের ছবিগুলো তুলেছেন সাংবাদিক মোছাব্বের হোসেন

Comments

The Daily Star  | English
trump zelenskiy meeting in washington

Trump tells Ukraine to give up on NATO and Crimea ahead of Zelensky meeting

Trump will meet first Zelensky and then the leaders of Britain, Germany, France, Italy, Finland, the European Union and NATO, the White House says

1h ago