পদ্মার ডিক্রির চর: ‘ক্ষমতাবানদের’ দখলে যে চরের চাষাবাদ

পদ্মার ডিক্রির চর: ‘ক্ষমতাবানদের’ দখলে যে চরের চাষাবাদ
দিনের কাজ শেষে ঘরে ফিরছেন শ্রমিকরা | ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে গেলে জেগে ওঠে বিশাল চর। সেই চরে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহের স্বপ্ন দেখেন নদী পারের মানুষ। এক সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের লাঠিয়াল থাকতো চর দখলের জন্য। প্রতিপক্ষের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হতো।

বলা হতো—লাঠি যার, জমি তার। লাঠির সেই লড়াই বন্ধ হলেও থেমে নেই দখলদারিত্ব। পাল্টেছে কেবল দখলের ধরন। লাঠির পরিবর্তে হাতিয়ার হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা।

পাবনার ঈশ্বরদীতে লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নে রয়েছে পাঁচ হাজার বিঘার বেশি চরের খাস জমি। ডিক্রির চরের জমির দখল নিয়ে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দীর্ঘ ইতিহাস।

গত বছর ঈশ্বরদী উপজেলা ভূমি অফিস থেকে এই চরের (ডিক্রির চর তালবারিয়া মৌজা) প্রায় এক হাজার ১৫৮ দশমিক ২৮ একর খাস জমি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় দুইজনকে লিজ দেওয়া হয়েছে। পৃথক লিজের অনুলিপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

তাদের একজন একাদশ জাতীয় সংসদের পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নাজমুল ইসলাম। তাকে আট লাখ ২০ হাজার টাকায় লিজ দেওয়া হয়েছে প্রায় এক হাজার ৪০ একর জমি। গত বছরের ১২ এপ্রিল সহকারী কমিশনার (ভূমি) টিএম রাহসান কবির লিজ ইস্যু করেছিলেন।

নিজের আত্মীয়র নামে চরের বিশাল জমির লিজের প্রসঙ্গে এর আগে প্রশ্ন করা হলে নুরুজ্জামান বিশ্বাস বলেছিলেন, চরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কাজ করেছেন। লিজ প্রদানের ব্যাপারে তিনি কোনো প্রভাব বিস্তার করেননি।

ঈশ্বরদী উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী ওপেন কোটেশনের মাধ্যমে চরের জমির নিলাম হয়।

প্রসঙ্গত, সরকারি খাস জমি বন্দোবস্তের নিয়ম অনুযায়ী খাস জমি বরাদ্দে ভূমিহীনরা অগ্রাধিকার পাবেন। ডিক্রির চরের বিবাদমান জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান, যে কারণে আদালতের নির্দেশেই গত দুই দশকের বেশি সময় ধরেই ওপেন কোটেশনের মাধ্যমে লিজ দেওয়া হচ্ছে।

ডিক্রির চরের কৃষকরা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ক্ষমতাবানদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে কৃষকদের চাষাবাদ করতে হচ্ছে।

তারা আরও জানান, ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা চরের জমির নিয়ন্ত্রণ করেন। লিজ গ্রহীতার কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়ে টাকার বিনিময়ে তারা কৃষকদের চাষের জন্য বরাদ্দ দেন।

গত বছর চরের প্রভাবশালী ব্যক্তি শামসুল আলম স্বপন ও আলম বাদশাসহ কয়েকজন জমি বরাদ্দ দিয়েছেন।

পদ্মার ডিক্রির চর: ‘ক্ষমতাবানদের’ দখলে যে চরের চাষাবাদ
‘ক্ষমতাবানদের’ কাছ থেকে চুক্তিভিত্তিক জমি নিয়ে কলা ও সবজি চাষ করেন শ্রমিকরা | ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

'চরে এক বিঘা জমি এক বছর চাষ করতে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত (জমির গুণগত মান ও ফসলের আবাদ অনুযায়ী) দিতে হয়েছে,' বলেন কৃষকরা।

চরের কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, 'আমরা চাষাবাদ করলেও চরের জমিতে আমাদের অধিকার নেই। প্রভাবশালীদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই জমি চাষ করতে হয়।'

লিজের চুক্তি অনুযায়ী, চরের জমি সাব-লিজ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, বিপুল পরিমাণ জমি তার একার পক্ষে চাষাবাদ করা সম্ভব না। এছাড়া চরের বিভিন্ন বিবাদমান পক্ষ থাকায় তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে চাষাবাদ করতে হয়। যে কারণে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

চরের জমি লিজ নিয়ে টাকার বিনিময়ে কৃষকদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ প্রশাসনের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবির কুমার দাস।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আদালতে মামলা চলছে। নিয়ম অনুযায়ী লিজ দেওয়া হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী, লিজ গ্রহীতা এসব জমি সাব-লিজ দিতে পারবেন না।'

এক সময় বিস্তীর্ণ এই চরে ধান-পাট চাষ হলেও এখন কলা ও সবজিসহ দামি ফসলের চাষ হচ্ছে। চর ঘুরে দেখা গেছে, জমিতে গড়ে উঠেছে বড় বড় কৃষি খামার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষকরা জানান, প্রকৃত কৃষকের চেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী কৃষকরাই বেশি সুযোগ পায়। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে চরের জমিতে দখলদারিত্ব চলে আসছে।

ডিক্রির চরের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব পুরোনো জানিয়ে স্থানীয় কৃষকরা বলেন, অনেক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন প্রভাবশালী দুই ব্যক্তি জাফর উদ্দিন গং ও শরিফ বিশ্বাস গংয়ের মধ্যে ফসল কাটা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সে সময় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। পরবর্তীতে সেই বিবাদ আদালতে গড়ায়। বছরের পর বছর মামলা চলায় আদালতের নির্দেশে চরের জমি চাষাবাদের জন্য ওপেন কোটেশনের মাধ্যমে লিজ দেওয়া হচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English
China urges US for fair trade talks

China warns countries against striking trade deals with US at its expense

Beijing "will take countermeasures in a resolute and reciprocal manner" if any country sought such deals, a ministry spokesperson said

38m ago