স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয় মানিকগঞ্জের হাজারি গুড়
খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হয় গুড়। হাতে নিয়ে চাপ দিলে এই গুড় গুড়ো হয়ে যায়। জিভে নিলেই মিঠা স্বাদ আর গন্ধের এই গুড় জানান দেয় কেন এর সু্খ্যাতি দেশজোড়া।
এটিই মানিকগঞ্জের হাজারি গুড়।
শুধু দেশেই নয়, মানিকগঞ্জের হাজারি গুড়ের খ্যাতি ছড়িয়েছে বিদেশেও। এই গুড়ের নামেই জেলার ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে 'হাজারি গুড় আর বাউল গান, মানিকগঞ্জের আসল প্রাণ।'
এই গুড় প্রবাসী বাংলাদেশিরা কিনে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান। এ ছাড়া, বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বাইরে এই গুড় যায় বলে জানান কারিগররা।
৩৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই হাজারি গুড় উৎপাদন হয় মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার গোপীনাথপুর উত্তরপাড়া ও ঝিটকা এলাকায়।
সুস্বাদু হাজারি গুড় কীভাবে তৈরি হয় তা দেখতে ও জানতে সম্প্রতি ওই এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। কথা হয় বংশপরম্পরায় হাজারি গুড় তৈরির কারিগরদের সঙ্গে।
সকাল ৬টার দিকে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর উত্তরপাড়ার গাছি মোজাফফর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জ্বলন্ত মাটির চুলার ওপর চারকোণা স্টিলের পাত্রে খেজুর গাছের রস ঢালা হচ্ছে। একজন চুলায় জ্বাল দিচ্ছেন আর অন্য দুজন পাত্রের রস নাড়ছেন। ২০-২৫ মিনিট ধরে পাত্রে জ্বাল দেওয়া রসের ঘনত্ব যখন কিছুটা বেড়ে যায়, তখন হালকা খয়েরি রঙ নেয়। সঙ্গে সঙ্গে সেই রস মাটির পাত্রে ঢালা হয়। এরপর মোজাফফর ও তার এক সহকারী সেই জ্বাল হওয়া রসকে বাঁশের কাঠি দিয়ে সজোরে নাড়তে থাকেন। এতে রসের ঘনত্ব বাড়তে থাকে এবং কিছুটা সাদা রঙ ধারণ করে। এভাবে ১০-১৫ মিনিট ধরে নাড়ার পর তা ঘরের মেঝেতে রাখা ছোট ছোট পাত্রে ঢালা হয়। এরপর বিশেষ এই গুড়ে হাজারি সিল বসানো হয়। এভাবেই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড়।
মোজাফফর হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাতে নিয়ে এই গুড় চাপ দিলে গুড়ো হয়ে যায়। জিভে দিলেই গলে যায়। স্বাদে অতুলনীয়। ১০ থেকে ১২ কেজি রসে এক কেজি হাজারি গুড় হয়। প্রতি কেজি গুড় ১৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ গুড়ের বেশ চাহিদা। তবে খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি কমে গেছে। এ ছাড়া, জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। এ কারণে এই গুড়ের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।'
ঝিটকা শিকদার পাড়ার ষাটোর্ধ রহিজ উদ্দিন হাজারি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাজারি প্রামাণিক ছিলেন আমার পূর্বপুরুষ। আমি হাজারি প্রামাণিকের সপ্তম বংশধর। প্রায় ৩৫০ বছর আগে ঝিটকা শিকদার পাড়ার হাজারি প্রামাণিক এই খেজুর গুড় তৈরি করেছিলেন বলে শুনেছি। সেই থেকে এই গুড়ের নাম হয়ে যায় হাজারি গুড়। এই গুড় দেশের আর কোথাও হয় না।'
তিনি বলেন, 'একসময় শতাধিক পরিবার এই গুড় তৈরি করতো। এখন ২০ থেকে ২৫টি পরিবার এই গুড় উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। শীত এলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পিঠা-পায়েস তৈরি হয়। এ সময়টাতে খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা, বিশেষ করে হাজারি গুড়ের চাহিদা বেড়ে যায়।'
জেলার খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ নান্নু বলেন, মূলত হাজারি পরিবারের সদস্যরাই এই গুড় উৎপাদন করত। তাদের দেখে আশেপাশের অন্যান্যরাও এই গুড় তৈরি শুরু করেছিল। তবে এই গুড় তৈরিতে খরচ বেশি ও জটিল প্রক্রিয়ার কারণে তারা আর এটিতে খুব বেশি নেই। হাজারি পরিবারের সদস্যরাই এটি টিকিয়ে রেখেছেন।
ঐতিহ্যবাহী এই গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে এবং এর গুণগত মান বজায় রাখতে খেজুর গাছ রোপণ ও গুড় তৈরির কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড় শুধু মানিকগঞ্জের হরিরামপুরেই তৈরি হয়। এ গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে উপজেলায় ৫ লাখ খেজুর গাছ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে ৫ শতাধিক খেজুর গাছ রোপণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, এ গুড়ের গুণগত মান বজায় রাখতে গুড় তৈরির কারিগরদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। হরিরামপুর উপজেলাকে হাজারি গুড় পল্লী হিসেবে গড়ে তোলা হবে।'
নিজ চোখে এই গুড় তৈরি দেখতে চাইলে ভোররাতেই রওনা দিতে হবে। কেননা গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে সকাল ৬টার মধ্যে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে মানিকগঞ্জ জেলা শহর। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক হয়ে যাওয়া যায়। আবার গাবতলীর পর হেমায়েতপুর থেকে সিঙ্গাইর হয়েও মানিকগঞ্জে যাওয়া যায়। জেলা শহর থেকে ঝিটকা-হরিরামপুর সড়ক ধরে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পেরোলেই পৌঁছে যাবেন হাজারি গুড়ের কারিগরদের ঠিকানায়। যেকোনো যানবাহনে চড়ে খুব সহজেই যাওয়া যায়।
এই পথে আসা-যাওয়ার সময় চোখে পড়বে সড়কের পাশে সারি সারি খেজুর গাছ। গাছে ঝুলছে মাটির হাড়ি। গাছিরা গাছ থেকে রসভর্তি হাড়ি নামাচ্ছেন। চোখ জুড়িয়ে যাবে। মনও ভরে যাবে। আর জিভে যদি একটু হাজারি গুড় লাগে, তাহলে তো কথাই নেই। এর স্বাদ মুখে লেগে থাকবে অনেকদিন।
Comments