‘হামরা কাজ না কইরলে তোমরা খাবার পাইবেন কোনটে থাকি’

শীত উপেক্ষা করে ফসলের মাঠে কৃষক। লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাটে বোরো ধানের চারা বুনছেন কৃষক। ছবি: এস দিলীপ রায়/ স্টার

লালমনিরহাটসহ উত্তরের জেলাগুলোতে গেল দেড় সপ্তাহ ধরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। কনকনে ঠান্ডায় জনজীবন প্রায় স্থবির। ২০ দিন পর গতকাল সূর্যের মুখ দেখেছে মানুষ। তবু সবাই যখন ঠান্ডায় প্রায় ঘরবন্দি তখনও কিন্তু থেমে নেই ফসলের মাঠে কৃষকের কাজ।

কথা হয় লালমনিরহাটের ষাটোর্ধ্ব কৃষক আফসার আলীর সঙ্গে। কনকনে ঠান্ডায় মাঠে কীভাবে কাজ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'হামরা যদি মাঠোত কাজ না করি ফসল ফলাইবে কাই। তোমরাগুলা খাবার পাইবেন কোনটে থাকি। জারোত কোকড়া নাগি ঘরোত শুতি খাইকলে কি আর কাম হইবে।'

ধরলা নদীপাড় বনগ্রামের কৃষক আফসার আলী বলেন, 'জার কি আর হামাক না নাগে। হামাকও জার নাগে। জারের ঠ্যালায় হা-পাও গুটি থুইয়া আইলসিয়া হয়া থাকলে হবে। সময় থাইকতে ফসল ফলাইতে হবে। তাক না হইলে ফলন ভালো পাওয়া যাবে না।'

ঠান্ডায় হাত গুটিয়ে আসে। আঙ্গুল অসার হয়ে আসে। পাঁজরের হাড়ে ঠান্ডা কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তারপরও জমিতে বোরো ধানের চারা বুনছেন আফসার আলী।

বলেন, 'হামরাগুলা কি খালি হামারগুলার নিজের চিন্তা করি। তোমারগুলারও চিন্তা করি। হামার খাবার ফলাই। এ খাবার তোমরাগুলা খায়া বাঁচি আছেন।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাটে কৃষকরা মাঠে কাজ করছেন। ছবি: এস দিলীপ রায়/ স্টার

একই গ্রামের কৃষক কফিল উদ্দিনও (৫৮) কাজ করছেন মাঠে। বলেন, 'জারোত কষ্ট করিয়া ধান লাগবার নাইকছি। এ্যালা যদি ধান না নাগাই তা হইলে অসময়ে ধান লাগাইলে ফলন ভাল হবার নয়।'

মনের জোরে কাজ করেন বলে জানান কফিল। বলেন, 'বিয়ান থাকি সন্ধ্যা পযর্ন্ত মাঠোত কাজ করি। জারের কারণে মাঝে মাঝে এ্যাকনা করি আগুন পোহাই। তাতে এ্যাকনা শান্তি পাওয়া যায়।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার দুড়াকুড়ি গ্রামে ভুট্টার খেতে কাজ করছিলেন ৬৬ বছরের  কৃষক মোবারক আলী। লুঙ্গি, একটা সোয়েটার, মাথায় একটা গামছা বাঁধা আর খালি পায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বলেন, শীতের মধ্যে কাজ শুরু করলে তেমন ঠান্ডা আর লাগে না। ছোটবেলা থেকেই এই সবের সঙ্গে যুদ্ধ করে এসেছেন।

ভুট্টার খেতে কাজ করছেন কৃষক মোবারক আলী। ছবি: স্টার

'মুই এ্যাকলায় সকাল থাকি ভুট্টা খেতোত কাম করবার নাইকছোং। রোদ, ঝরি, জার সোকে হামারগুলার সহ্য হয়। ছোটবেলা থাকি এইল্যার সাথে যুদ্ধ করিয়া কৃষি কাম করি আইসবার নাইকছি। হামারগুলার কষ্ট হইলেও ফসল ফলায়া হামরা খুশি। হামরাগুলোতো দ্যাশের মাইনসের জইন্যে খাবার ফলাই। সবাই খাবার খ্যায়া বাঁচি থাকে,' তিনি বলেন।

৬৫ বছর বয়সী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সোনাইকাজী গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন,' জার সহ্য করিয়া মুই সকাল ৮টার মধ্যে জমিত আসিয়া কাজ করোং। এ্যালা যদি মুই ধান না নাগাং তা হইলে চারাগুলা নষ্ট হয়া যাইবে। সবজি খেতের আগাছাগুলা সাফ না কইরলে সবজির ফলন ভালো হবার নয়। হামারগুলার কষ্ট হয় ঠিক কিন্তু জার হামার সয়া গ্যাইছে।'

'হামরা বয়স্ক মানুষগুলা সকাল থাকি মাঠোত কাজ করি। জুয়ান মানুষগুলাক পাওয়া যায় না,' তিনি বলেন।

'হামরাগুলা যদি ঠান্ডা সহ্য করি ফসল না ফলাই তা হইলে ট্যাহা কোনটে পামো। ট্যাহা ছাড়া সংসার চইলবার নয়। এইল্যা ঠান্ডা হামারগুলার সহ্য হবার নাইকছ। চরোত আরো বেশি ঠান্ডা নাগে, বলছিলেন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে চর মনতলার কৃষক দিলবর হোসেন (৬০)।

'হামরা কৃষক মানুষ। হামরাগুলা যুদ্ধ করি ফসলের খেতোত। ঠিকমতো ফসল ফইল্যে হামারগুলার বিজয় হয়। হামরাগুলা হাসি খুশি থাকি। ঠান্ডা রোদ বৃষ্টি দেখি হামরাগুলা আর ভয় খাই না,' তিনি বলেন।

তবে আক্ষেপ ঝরে পড়ে তিস্তা নদীপাড়ের গোবর্ধান এলাকার কৃষক ফজলার রহমানের (৬৭) কণ্ঠে। বলেন, 'হামারগুলার কষ্ট কাইও দ্যাখে না। হামরা জারোত মরি গ্যাইলেও কাইও খবর নিবার নয়। আল্লাহর রহমতে হামরাগুলা জার সহ্য করির পাই। এতো জার যাবার নাইকছে তাও হামরা মাঠোত কাজ কইরবার নাইকছি।'

একই চরের হোসনা বেগম (৬২) বলেন, 'যত পুরান কাপড়চোপড় আছে সেগুলা গায়ে দিয়া ফসলের খেতে কাজ কইরবার নাইকছি। সকালে মাঠোত আসিয়া বিকালে বাড়িত যাঙ। জমিত ফসল না ফলাইলে ছেলেমেয়েরা কী খাইবে। জারোত ভয় খ্যায়া থাইকলে কোনো কাম হবার নয়। জারের সাথোত লড়াই করি হামাক বাঁচা নাগে।'

জারের সাথোত লড়াই করি হামাক বাঁচা নাগে বলছিলেন, তিস্তাপাড়ের কৃষি শ্রমিক হোসনা বেগম। ছবি: স্টার

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে এক লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে করা হবে ভুট্টা। তামাক রয়েছে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। আলুসহ সবজি ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে। অন্যন্য ফসল ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। দুই জেলায় কৃষি পরিবার রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পযর্বেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গেল ১০ দিন ধরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। তবে সোমবার থেকে দিনভর সূর্যের আলো থাকায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষকরাই এদেশের প্রকৃত যোদ্ধা, প্রকৃত দেশপ্রেমিক। কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে তারা ফসলের খেতে কাজ করছেন খাদ্য উৎপাদনে। শুধু ঠান্ডাই নয় তারা রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফসলের খেতে কাজ করেন। সময়মতো ফসল লাগানো ও উৎপাদন করতে কৃষকরা সব ধরনের দুর্যোগকে উপেক্ষা করেন।'

Comments

The Daily Star  | English
price hike of essential commodities in Bangladesh

Essential commodities: Price spiral hits fixed-income families hard

Supply chain experts and consumer rights activists blame the absence of consistent market monitoring, dwindling supply of winter vegetables, and the end of VAT exemptions granted during Ramadan.

14h ago