তাপদাহের মধ্যে পাহাড়ে বিশুদ্ধ পানির সংকট

ঝিরি থেকে এক কলসি পানি আনতে সময় লেগে যায় প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে।

চলমান তাপদাহের মধ্যে বান্দরবানের চিম্বুক-নীলগিরি সড়কের পাশের গ্রামগুলোতে তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ঝিরি থেকে এক কলসি পানি আনতে সময় লেগে যায় প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে। ঝিরি-ঝরনার পানি ২-৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে।

জেলা সদর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে কোরাং পাড়ায় বুধবার পানি বিতরণ করে রেড ক্রিসেন্ট। সেখানে পানি নিতে যাওয়া পাহাড়ি নারী-পুরুষরা বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা তুলে ধরেন।

সরেজমিনে চিম্বুক-নীলগিরি-থানচি সড়কের গেতসিমনি পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ঝিরির শেষ প্রান্তে মাটির নরম অংশে পাঁচ-ছয় ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে মাটি ভেদ করে অল্প অল্প করে আসছে পানি। পালা করে পাড়ার মোট ৭৫টি পরিবারের সবাই সংগ্রহ করছেন সেই পানি।

নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ওই গর্তের ভেতর ঢুকে পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায়।

পানি বিতরণের খবর শুনে খালি কলসি নিয়ে পানি অপেক্ষায় রতঃ এম্পু পাড়ার এক নারী। ছবি: স্টার/মংসিং হাই মারমা

বান্দরবান-নীলগিরি সড়ক সংলগ্ন কোরাং পাড়া, ক্রাপুং পাড়া, সিতা পাড়া, বাগান পাড়া, ম্রলং পাড়া, গেতসিমনি পাড়াসহ মোট ৩৫টি পাড়া আছে। এসব পাড়ায় প্রায় পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পরিবারের বসবাস।

স্থানীয়রা জানায়, পাড়াগুলো পাহাড়ের চূড়ায় হওয়ায় পাড়া থেকে প্রায় এক হাজার ফুট নিচে নামলে ছোট ঝিরি বা ঝরনার দেখা মেলে। ঝিরিগুলোতে পানি নেই বললেই চলে। তবুও এর ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে তাদের।

তারা বলছেন, আগের মতো বড় বড় গাছ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ছোট ছোট ঝিরি-ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।

চিম্বুক বাজারের ব্যবসায়ী রেং রোয়াত ম্রো দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বান্দরবান-থানচি সড়কের পাশে ছোট-ছোট বাজারগুলোতে যারা দোকান করেন, তারা পানি কিনে ব্যবহার করছেন। কিন্তু গ্রামের মানুষদের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।'

কোরাং পাড়া বাজারের ব্যবসায়ী রেং য়ক ম্রো (৫০) বলেন, 'প্রচণ্ড গরমে পাহাড়ে মানুষের জীবনযাপনে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পানি সংকট পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।'

বাচ্চাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে পানি আনতে যাচ্ছেন এক ম্রো নারী। ছবি: স্টার/মংসিং হাই মারমা

একই পাড়ার বাসিন্দা লিয়াং কিম বম (৬৫) বলেন, 'শুষ্ক মৌসুম এলেই আমাদের এলাকায় মানুষদের খাবারের চাইতে বিশুদ্ধ পানির সংকট চরম অবস্থায় পৌঁছায়। আমাদের নারীরা প্রতিদিন পাড়া থেকে কয়েক হাজার ফুট নিচে নেমে খাবার পানি, গৃহস্থালি কাজের ও রান্নার পানি সংগ্রহ করেন।'

'গ্রীষ্মকাল এলে আমাদের গোসলের কথা ভুলে যেতে হয়। দুই-তিন দিন পর গোসল করতে পারি। তাও আবার এক-দুই লিটার পানি দিয়েই গোসল সারতে হয়,' বলেন তিনি।

কোরাং পাড়ার বেশিরভাগ বাসিন্দা ম্রো হলেও, এ পাড়ায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মোট প্রায় ২১০ পরিবারের বাস।

এ পাড়ার আরেক বাসিন্দা চিংহ্লাউ খেয়াং (৪২) জানান, তিনি গত ১৫ বছর ধরে এ পাড়ায় বাস করছেন। পাড়া সংলগ্ন সব ছোট ছোট ঝিরি-ঝরনাগুলো শুকিয়ে গেছে। খাবার পানির তীব্র সংকটে পড়েছে এলাকাবাসী।

এই সংকটে রেড ক্রিসেন্ট ও জেলার অনেকে খাবার পানি বিতরণ করায় এলাকাবাসী উপকৃত হয়েছে বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

কোরাং পাড়ার বাসিন্দা ও স্থানীয় গ্যালেঙ্গা ইউনিয়নের ওয়ার্ড সদস্য রেংওয়াই ম্রো ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নারীদের হাজার ফুট নিচে ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এক কলসি পানি আনতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায়।'

বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করছেন রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীরা। ছবি: স্টার/মংসিং হাই মারমা

বিশুদ্ধ পানি বিতরণের অন্যতম উদ্যোক্তা সাংবাদিক বাটিং মারমা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে পানির সংকট নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে পানি সমস্যার কথা জানতে পারি এবং মানবিক কারণে গত দুই বছর ধরে চিম্বুক-নীলগিরি এলাকায় বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করে আসছি। এ বছরও আমরা দুই-তিনজন মিলে পানি বিতরণের কাজ শুরু করি। পরে জেলা রেড ক্রিসেন্ট ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস ৫ লিটারের ১০০টি পানির জার দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।'

রেড ক্রিসেন্ট বান্দরবান ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক অমল কান্তি দাশ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুর্গম এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের তথ্যের ভিত্তিতে ও সহযোগিতায় রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে খাবার পানি বিতরণ করা শুরু করেছি। বর্ষা মৌসুম না আসা পর্যন্ত এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।'

যোগাযোগ করা হলে বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখছি যে, সাংবাদিক ভাইয়েরা চিম্বুক পাহাড়ে পানি বিতরণ করছেন। তাই তাদের কাজে সহযোগিতার অংশ হিসেবে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের পক্ষ থেকে ১০০টি ১০ লিটার জার দিয়েছি।'

সংকট নিরসনের বিষয়ে তিনি বলেন, 'বান্দরবান জেলায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বান্দরবান সদর ও লামা পৌরসভায় এডিবির অর্থায়নে দুটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আরও দুটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদন পেলে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সুপেয় পানির সংকট কমে যাবে।'

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago